বুধবার ● ২৩ অক্টোবর ২০১৯
প্রথম পাতা » ঢাকা » তামাক কোম্পানিতে সরকারের অংশীদারিত্ব রেখে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব নয়
তামাক কোম্পানিতে সরকারের অংশীদারিত্ব রেখে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব নয়
ঢাকা :: তামাক কোম্পানিতে সরকারের অংশীদারিত্বের সুযোগ নিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কার্যক্রমে প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপ করছে তামাক কোম্পানি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব হবেনা। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশে আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়নের অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। ৩৩টি দেশের মধ্যে যে ৩টি দেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে মাত্র দুটি দেশ, জাপান এবং জর্ডান। আজ ঢাকায় প্রকাশিত ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক: এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ২০১৯’ গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে একইসাথে ‘প্রজ্ঞা তামাক নিয়ন্ত্রণ সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০১৯’ এর বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে দেয়া বক্তব্যে মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার যে ঘোষণা দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় যা কিছু করা দরকার তা করবে। সেইসাথে তিনি এই গবেষণার তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের সাথেও শেয়ার করার আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানের গেস্ট অব অনার সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেন, আমাদের সংবিধানে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তামাকের কারণে এই অধিকারগুলো ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সুতরাং আইনগত, নৈতিক এবং অর্থনৈতিক যুক্তিতেও তামাক নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, রাষ্ট্রপতির হাতে তামাক কোম্পানির শেয়ার থাকা অসম্মানজনক। সুতরাং যেকোন উপায়ে সরকারের হাতে তামাক কোম্পানির যতটুকু শেয়ার আছে তা প্রত্যাহার করতে হবে। বৈশ্বিক তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক ২০১৯ এর গবেষক এবং লেখক ড. মেরি আসুন্তা বলেন, “যত তাড়াতাড়ি সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কোড অব কন্ডাক্ট গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা হবে, ততই তাড়াতাড়ি সরকার এর সুফল পাবে। এটি তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ থেকে কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেবে এবং অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। তামাক কোম্পানি যেন কোন ভাবেই সংসদ সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতে না পারে তা এই কোড অব কন্ডাক্ট দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে।”
গবেষণায় আর্টিক্যাল ৫.৩ এর কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন করতে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি থেকে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহারের ব্যাপারে জোর সুপারিশ করা হয়। ফলাফলে বলা হয় বহুজাতিক তামাক কোম্পানিতে সরকারের ৯.৪৮% শেয়ার এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে উচ্চ পর্যায়ের ৪-৬ জন সরকারি কর্মকর্তা মনোনীত থাকায় তামাক কোম্পানির পক্ষে বিগত বছরে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রে অবাধে প্রবেশ করে তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপসমূহে হস্তক্ষেপ করা সহজ হয়েছে। একইসাথে তামাক কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং তামাক নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখার ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই)-কে বাংলাদেশে ব্যবসা করার অনুমতি প্রদান, বিশেষ আদেশ জারির মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক বিএটিবিকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি কর অব্যাহতি প্রদান এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের এক্স-ফ্যাক্টরি প্রাইস প্রথা বাতিল করে খুচরা মূল্য নির্ধারণ করার পর চূড়ান্ত বাজেটে সেই অবস্থান থেকে সরে এসে ট্যারিফ ভ্যালুর ওপর কর নির্ধারণ করা প্রভৃতি কারণে হস্তক্ষেপ সূচকে প্রাপ্ত স্কোর প্রায় একইরকম রয়ে গেছে। এছাড়া বিড়ি মালিক সমিতির দাবির প্রেক্ষিতে বিগত অর্থবছরের চূড়ান্ত বাজেটে বিড়ির দামে কোন পরিবর্তন করা হয়নি। তামাক কোম্পানির সিএসআর কর্মসূচিতে সরকারি কর্মকর্তাগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) এর অর্থ প্রদান এবং পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তামাক কোম্পানি ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ প্রভৃতির কারণে এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ প্রতিপালনে সরকারের অবস্থান দুর্বল হয়েছে। তবে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ এর আলোকে দুটি খসড়া আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে, একটি জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি) এর জন্য, অন্যটি সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত সকল কর্মকর্তাবৃন্দের জন্য, যা অত্যন্ত ইতিবাচক। খসড়া দুটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
গবেষণায় তামাক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ বা আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য আর্টিক্যাল ৫.৩ এর গাইডলাইনের আলোকে প্রণীত খসড়া আচরণবিধি চূড়ান্তকরণ, তামাক কোম্পানির সাথে অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ বন্ধ করার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য নীতিসমূহ সুরক্ষায় সকল যোগাযোগের তথ্য প্রকাশের জন্য সরকার কর্তৃক উদ্যোগ গ্রহণ, তামাক কোম্পানিকে প্রদত্ত সকল সুবিধা প্রত্যাহারসহ তামাক ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ২০১৮ সাল থেকে গবেষণার মাধ্যমে ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক’ প্রকাশ করে আসছে। গবেষণায় সরকার তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপসমূহ কিভাবে আমলে নেয় এবং সেগুলো মোকাবিলায় কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ গাইডলাইনের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়। সূচকে স্কোর যত বেশি, হস্তক্ষেপ তত বেশি। ২০১৯ হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৭৭, যা গতবছর ছিল ৭৮। অর্থাৎ আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়নে সরকারের অগ্রগতি/স্কোর এবছরও সন্তোষজনক নয়। এই কর্মকাণ্ডে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছে গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি), থামাসাত ইউনিভার্সিটি, থাইল্যান্ড; স্টপ (স্টপিং টোব্যাকো অর্গানাইজেশনস অ্যান্ড প্রোডাক্টস) প্রজেক্ট ; এবং ইনিস্টিটিউট অব গ্লোবাল টোব্যাকো কন্ট্রোল (আইজিটিসি), জনস্ হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ।
প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) যৌথভাবে আজ ২৩ অক্টোবর ২০১৯, বুধবার, সিরডাপ অডিটরিয়ামে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ‘প্রজ্ঞা তামাক নিয়ন্ত্রণ সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০১৯’ এর বিজয়ী হিসেবে সেরা প্রিন্ট/অনলাইন মিডিয়া বিভাগে সুহাদা আফরিন, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক প্রথম আলো ও শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট (রাজশাহী), বাংলানিউজ২৪.কম এবং সেরা টিভি রিপোর্ট বিভাগে মামুন আবদুল্লাহ, রিপোর্টার, সময় টেলিভিশন পুরস্কার পেয়েছেন। বিজয়ীরা প্রত্যেকে ৫০ হাজার টাকা, একটি সনদ এবং ক্রেস্ট উপহার হিসেবে পেয়েছেন। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় তথ্য মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, এমপি। গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, সভাপতি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং অনারারি প্রেসিডেন্ট, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ড. মেরি আসুন্তা, হেড অব গ্লোবাল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি, জিজিটিসি, থামাসাত ইউনিভার্সিটি, থাইল্যান্ড এবং মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, বাংলাদেশ কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর, সিটিএফকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়; ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস; দি ইউনিয়ন, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসসহ তামাকবিরোধী সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এটিএন বাংলার প্রধান প্রতিবেদক ও এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণ এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রজ্ঞা’র হেড অব টোব্যাকো কন্ট্রোল মো: হাসান শাহরিয়ার।