শনিবার ● ১৮ জানুয়ারী ২০২০
প্রথম পাতা » পাবনা » মরা নদী, ভরা অতীত : চলনবিলের নদ-নদী বাঁচালে বিল বাঁচবে
মরা নদী, ভরা অতীত : চলনবিলের নদ-নদী বাঁচালে বিল বাঁচবে
মো. নূরুল ইসলাম, পাবনা প্রতিনিধি :: শুকনো মৌসুম না আসতেই পাবনার চাটমোহর উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত একদার স্রোতশিনী গুমানী ও বড়াল নদী শুকিয়ে গেছে। উপজেলার পৌরশহরের প্রানকেন্দ্রে বোঁথর, ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে পূর্ব-পশ্চিমের যেদিকেই তাকানো যায় বড়াল নদীটির বুকে এখন শুধুই বোরো ধানের বীজতলা বা রবি সরষের আবাদ। অথচ মাস দুই আগেও গুমানী ও বড়াল নদীর বুক দিয়ে হাজারমনী মহাজনী নৌকা, যাত্রীবাহী বড়বড় শ্যালো (ইঞ্জিন চালিত) নৌকা চলাচল করেছে। আর বড়াল নদী সেতো কবেই মরে গেছে। তার বুকে এখন কচুরিপানা আর বয়লার মুরগীর বিষ্ঠা। নদীর দু’পার দখলদারীরা মুরগীর খামার করে সরাসরি খামার থেকে নদীতে বিষ্ঠা ফেলছে।
উপজেলার মির্জাপুর হাটের একজন বড় ব্যবসায়ী শ্রী সুবাস দাস বলেন, এই নদীপথই আমাদের সার-ডিজেল আনতে হয়। খরচ কম হয় তাই আমরা নদী নির্ভর ব্যবসা করতাম। এখন শুকনো মৌসুমের আগেই নদী শুকায়ে যায়। আমাদের বেশি খরচে সড়ক পথে মালামাল আনতে হয়।
ওই হাটের আরেক ব্যবসায়ী আলহাজ্ব জামাল উদ্দিন বলেন, মির্জাপুরে অনেক ধানের চাতাল। অটো রাইচমিল। আমার বড়বড় শহরে এই নদী পথেই চাল পাঠাই নৌকায়। গত বছর থেকে নদী বর্ষার শেষ দিকে শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। নদী ভরাট হয়ে গেছে।
অষ্টমনিষা হাটের পাশের বাসিন্দা কৃষক রহমত আলী বলেন, এই নদীতে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি নিয়ে আমরা বোরো ধানে সেচ দিতাম। সেই নদী এখন আবাদ শুরুর আগেই শুকিয়ে যায়।
মির্জাপুর-অষ্টমনিষা গুমানী নদীর ঘাটের ইজারাদার নাদের আলী (৫৫) বলেন, আমার জীবনে আমি এই নদীর পানিশূন্য দেখি নাই। কিন্তু গতবছর থেকে চৈত্রমাস না আসতেই পানিশূন্য হয়ে যায়। আমরা শুকনোর উপর বসে ঘাট পাড়ানি তুলি।
গুরুদাসপুরের সিঁধুলাই সমাজ কল্যাণ সমিতি(এসএসএস) পরিচালিত নৌকা স্কুলের মির্জাপুর শাখার ব্যবস্থাপক নাজমুল হুদা বলেন, গুমানী নদীর পাড়েই আমাদের বেশী কাজ। আর আমাদের নৌকাগুলো একটু অন্যরকম, বড়। পানি দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ায় আমাদের নৌকা স্কুল চালাতে বিপাকে পড়তে হয়েছে।
মির্জাপুর হাটের পশ্চিম পাশে গুরুদাসপুর থেকে বয়ে এসে করতোয়া নদী মিশেছে গুমানীতে। সেই মোহনার ঘাটের পাড়ানি নাথুরাম তরণী দাস (৭০) স্মৃতি হাতরে বলেন, কি বলবো বাপু এই গুমানী নদীর এক সুময় এতো স্রোত ছিলো যে, এক ঘাটের মানুষ লিয়ে অন্যঘাটে নৈকে লিতে যান বাড়াই যাইত। আমি ছোটবেলা শুনিচি গুমানী ছিলো মানুষ খাউয়া নদী। কেউ এই নদীতে পড়লি আর খুঁজে পাওয়াই যাইতো না। কি যে হইলো সেই নদীতে এখন পানিই থাকে না। অথচ মরা এই নদীটির একদা ছিলো ভরা অতীত। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর-চাচকৈর হয়ে গুমানী নদী পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা-নিমাইচড়া ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। মির্জাপুর হাটের পাশে গুমানীর সাথে এসে মিশেছে করতোয়া নদী। আর একটু এগিয়ে গিয়ে হয়ে বড়াল নাম নিয়ে বয়ে গেছে বগুদুর। ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর উপজেলা হয়ে মিশেছে সিরাজগঞ্জের চাটমোহর ভাঙ্গুড়া উপজেলার সীমানায় নুননগর নামক স্থানে গুমানী বড়াল নদীতে মিলিত শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ীর একটু আগে হুরাসাগরে। তারপর গিয়ে পড়েছে একেবারে বড়নদী যমুনায়। এ অঞ্চলে কর্মরত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার বলেন, নদী নব্যতা হারিয়েছে স্রোতহীনতায়। আরেকটা বিষয় হলো নদীপাড়ের মাঠে অপরিকল্পিত ভাবে গভীর নলকূপ বসিয়ে আবাদ করা হচ্ছে। এতে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে টান পড়ছে, দ্রুত ভূ-উপরিস্থ পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক এসএম মিজানুর রহমান বলেন, শুধু গুমানী নয়, চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত ছোটবড় ১৬টি নদ-নদীই শুকনো মৌসুম শুরুর আগেই নব্যতা হারায়। নদীগুলো খনন না করলে এ অবস্থার আরও অবনতি হবে। তিনি বলেন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলনে আমাদের এ জন্যই জারি রাখতে হবে। নদী রক্ষা না হলে চলবিল হারিয়ে যাবে।