সোমবার ● ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২০
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » তবারক আলী পলিথিন-ঝালমুড়ি বিক্রি,গাড়ী চুরি-ইয়াবা বিক্রি, হঠাৎ করেই বনে গেলেন কোটিপতি
তবারক আলী পলিথিন-ঝালমুড়ি বিক্রি,গাড়ী চুরি-ইয়াবা বিক্রি, হঠাৎ করেই বনে গেলেন কোটিপতি
স্টাফ রিপোর্টার :: কথায় আছে মানুষের ভাগ্য খুলতে সময় লাগে না। যে কোন সময় ঘটতে পারে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে। তবে সৎভাবে চলতে গেলে ভাগ্য খুলতে সময় লাগে ঠিকই কিন্তু সেটা থেকে যায় চিরস্থয়ী। আর অসৎভবে যদি কারোর ভাগ্যের সিকে খুলে থাকে তবে ক্ষনিকের ভালো থাকা হলেও তা থাকে না চিরস্থায়ি। এমনই এক জন মানুষের খোজ পাওয়া গেলো যিনি তার ভাগ্যের চাকাঁ ঘুরাতে প্রথমে কষ্ট করতে হয়েছে অনেক কিন্তু তিনি ধৈর্য্য ধরতে পারেননি সৎ পথে আর তাই বেছে নিলেন অসৎ পথ আর বনে গেলেন রাতারাতি কোটিপতি। তার নাম তবারক আলী। এক যুগ আগেও তিনি ফেরি করে পলিথিন বিক্রি করতেন। মাঝে কিছু দিন বিক্রি করেছেন ঝালমুড়ি। কিন্তু এসবে যে আয় তাতে চলছিল না দিন। সব ছেড়ে দিয়ে মাইক্রোবাসে হেলপারির চাকরি নেন।
দীর্ঘ সময় দোকানে দোকানে পলিথিন বিক্রি করায় ’পলিথিন তবারক’ হিসেবে পরিচিত পান গোটা বিশ্বনাথে। কিন্তু এক যুগ পর এসে সেই তবারক এখন কোটিপতি, দানবীর।
সর্বত্র প্রশ্ন কি করে সম্ভব এমনটা। কি এমন আলাদীনের চেরাগ পেয়েছেন তিনি? সবই খোলাসা হয়ে যায় সবার কাছে। মাদক কারবারিই বদলে দিয়েছে তার জীবন।
ছিলেন গাড়ী চোর। মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে হয়েছেন কোটিপতি। এলাকায় পেয়েছেন দানবীরের খেতাব। মাত্র ৩ বছরে কিভাবে তা সম্ভব। একমাত্র চুরির পাশাপাশি মাদক ব্যবসা ছাড়া। আর সেই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করেছে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের পাঠাকইন গ্রামের মৃত আলকাছ আলীর পুত্র মাদকসম্রাট তবারক আলী। আবার জনশ্রুতি রয়েছে মাদকের জগতে সে ইয়াবা সুমন নামে পরিচিত। আর তার (তবারক) নিয়ন্ত্রনে নারী-পুরুষের সম্বন্বয়ে গঠিত মাদকের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে বলেও জানা গেছে।
দানবীর খেতাব পাওয়ায় তবারকের প্রভাবও এলাকায় অন্য সবার চেয়ে কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে সরকারি সড়কের পার্শ্বের কাজ কর্তন করে বিল্ডিং নির্মাণ করতে থাকলেও এলাকার কেউ তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেননি। বিভিন্ন ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় থাকা তবারকের বিরুদ্ধে কথা বললে আতংকের মধ্যে থাকতে হয় এলাকাবাসীকে।
দীর্ঘদিন ধরে নিজের প্রভাব কাটিয়ে মাদকসম্রাট তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমন ও তার স্ত্রী ইয়াবা জগতের রাণী মুখোশধারী ব্যবসায়ী সাবিনা আক্তার নিজের রমরমা ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে গেলে তা ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। কিন্তু গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টার দিকে সিলেট থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবতনের একটি বাস থেকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এসআই আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশের একটি দল ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা মূল্যের ৬১ হাজার পিছ ইয়াবাসহ ‘নাহিদা বেগম ও শাহিনা খাতুন’ নামের দুজন নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেন। ওই দুজন ছিলেন তবারক-সাবিনার সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান সদস্য। আর গ্রেফতারের পর ডিবি পুলিশের হাতে জিজ্ঞাসাবাদে নাহিদা-শাহিনা হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশকে জানায় কুখ্যাত মাদকসম্রাট তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমন ও তার স্ত্রী ইয়াবা জগতের রাণী মুখোশধারী ব্যবসায়ী সাবিনা আক্তারের হয়ে তারা কাজ করে। আর তবারক-সাবিনা তাদেরকে (নাহিদা-সাবিনা) দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা বহন/বিক্রয় করে আসছেন। এ ঘটনায় হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশের এসআই আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে তবারক-সাবিনাসহ গ্রেপ্তারকৃতদের অভিযুক্ত করে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৬ (তাং ৬.০২.২০ইং)।
অভাবের সংসারের সন্তান হওয়াতে লেখাপড়া করা হয়নি তবারকের। বরং মাত্র ১৩ বছর বয়সে সংসারের হাল ধরার জন্য উপজেলার বিভিন্ন বাজারে বাজারে পলিথিন বিক্রি শুরু করে সে। জীবন জীবিকার তাগিতে পলিথিন বিক্রি করা ছেড়ে শুরু করে চানাচুর-ঝালমুড়ি বিক্রি। এরপরও অভাব তার নিত্যসঙ্গি। ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে তবারক যোগ দেয় লাইটেসের (মাইক্রোবাস) হেলপারির কাজে। লাইটেসের হেলপার থেকে এক সময় চালক হয়ে যায় তবারক। প্রায় ৩ বছর পূর্বেও যার নুন আনতে পান্তা ফুরাতো, বর্তমানে সেই তবারকের (নিজের বা আত্মীয়-স্বজনদের নামে) সম্পদের তালিকায় প্রায় ৫০ একর ভ‚মি, ৫টি হাইয়েস, ৩টি নোহা, ৩টি এলিয়েন কার, ৩টি বাস (ঢাকা-গাজীপুর সড়কে), ২টি ডিস্ট্রিক্ট ট্রাক, ১৬টি সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, ৭টি দোকান কোঠা (সিলেট শহরে-২, বিশ্বনাথ-৩, লালাবাজার-১, কুরুয়া-১) এবং বিশ্বনাথসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ব্যাংকে তবারক বা তার স্ত্রী ইয়াবা জগতেররাণী মুখোশধারী ব্যবসায়ী সাবিনা আক্তারের নামীয় একাউন্টগুলো বিপুল পরিমাণ টাকা রয়েছে জনশ্রুতি রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক সম্রাট তবারক ও ইয়াবারাণী সাবিনার একাউন্টে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা এসে জমা হচ্ছে জমা হচ্ছে বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। তাছাড়া বিশ্বনাথ উপজেলা সদরের পুরাণ বাজারের শরিষপুর গ্রামে চলমান রয়েছে ৫ তলা বিশিষ্ট ও রামপাশা ইউনিয়নের পাঠাকইন গ্রামে ডুপ্লেক্স বিল্ডিং নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আর এসব বিল্ডিং নির্মাণে প্রায় ৩-৪ কোটি টাকা করে ব্যয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এলাকায় আরো জনশ্রুতি রয়েছে তবারক প্রায় ২-৩ কোটি টাকা বিভিন্ন মানুষকে ঋন হিসেবে দিয়েছে। আর মাদকসম্রাট কাছ থেকে ঋন নেওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গও।
গাড়ীর চালক হওয়ার পরই অপরাধ জগতে পা রেখে তবারক। শুরু করে গাড়ী চুরি। ‘পলিথিন তবারক, চানাচুর তবারক, পিচ্চি তবারক’সহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম পাওয়া নতুন নাম পায় তবারক চোরা হিসেবে। গাড়ী চুরি করা শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই তবারক আন্তঃবিভাগীয় গাড়ী চোর দলের একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠে। ফলে ২০১০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিলেট বিভাগের বিভিন্ন থানায় তবারকের বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে ৭টি মামলা ও ২টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়েরের তথ্য পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। এর পরিমাণ আরোও বৃদ্ধি পেতে পারে তদন্তে। চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে দায়ের করা এসব মামলায় একাধিক বার গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করতে হয়েছে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনকে। একাধিক চুরির মামলার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর বিশ্বনাথ থানা পুলিশ তবারককে ২ দিনের রিমান্ডে আনে। আর পরদিন বিকেল ৩টার দিকে হাতকড়াসহ থানা হাজত থেকে পালিয়ে যায় সে (তবারক)। অবশ্য পালিয়ে যাওয়ার ৭ ঘন্টার মধ্যেই তাকে আবার গ্রেফতার করে পুলিশ। এঘটনায় সেসময় থানা পুলিশের দুই সদস্যকে ক্লোজ করা হয়েছিল।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে গ্রেফতারের পর জেলহাজতে একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ীর সাথে তবারকের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এসময় বাড়ির গাছ-বাঁশ বিক্রি করে তার জামিন করান পরিবারের লোকজন। আর জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে এসে ইয়াবা বিক্রির সাথে জড়িত হয়ে উঠে তবারক আলী। আর এখন সে তার নিজস্ব মেশিন দিয়ে ইয়াবা তৈরি করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছে নিজের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। আর মাদকের জগতে নিজের নাম বদলে সে ইয়াবা সুমন হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ইয়াবা আনা-নেওয়া বা বিক্রির কাজে তবারক গরীব-অসহায় নারীদের টাকার লোভ দেখিয়ে ব্যবহার করে আসছে বলেই সে (তবারক) এতোদিন পর্দার আড়ালেই থেকে যায়। বছর দেড়েক পূর্বে তার বাড়ির কাছে দুইটি অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ পাওয়ার পর ও গ্রামের মসজিদ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তবারকের ইয়াবা কাহিনী সামনে চলে আসে।
২০১৯ সালে এসে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনের বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ থানায় আরোও দুটি মামলা ও দুটি জিডি দায়ের করা হয়। এ বছরের ২৬ আগস্ট ৩৬(১) এর ১৯(ক) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন-২০১৮ অনুযায়ী বিশ্বনাথ থানার এসআই দেবাশীষ শর্ম্মা বাদী হয়ে তবারকসহ ৩ জনকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা (নং ২৪, তাং ২৬.০৮.১৯ইং) দায়ের করেন। এ ঘটনায় বিশ্বনাথ-লামাকাজী সড়কের আমজদ উল্লাহ কলেজের সামন থেকে আধা কেজি গাঁজাসহ বহুল আলোচিত তবারকের স্ত্রী সাবিনা বেগমের মালিকানাধীন সিএনজি চালিত অটোরিক্সা (সুনামগঞ্জ-থ ১১-২০৬৭) জব্দ করে পুলিশ। আর গত ২৪ অক্টোবর আদালতে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনকে অভিযুক্ত করে থানা পুলিশ সেই মামলার চার্জশিট আদালতে প্রেরণ করে।
এরপর একই বছরের ১৬ অক্টোবর সরকারের বিভিন্ন দপ্তর বরাবরে তদন্ত সাপেক্ষে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনকে আইনের আওতায় আনার দাবীতে রামপাশা ইউনিয়র পরিষদের চেয়ারম্যানসহ এলাকায় প্রায় ৩ শতাধিক ব্যক্তি স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এরপূর্বে তবারকের পক্ষে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বারসহ এলাকার প্রায় শতাধিক ব্যক্তি স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি প্রদান করেন। তবারকের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর প্রদান করা স্বাক্ষকলিপিতে স্বাক্ষর দেওয়ায় ১৭ অক্টোবর পাঠাকইন গ্রামের ময়না মিয়ার পুত্র চুনু মিয়ার উপর হামলা করেন তার (তবারক) পক্ষের লোকজন। এ ঘটনায় চুনু মিয়া বাদী হয়ে তাকে (চুনু) হত্যা করানোর উদ্দেশ্যে হামলা করার অভিযোগে তবারকসহ ৭ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা (নং ১১, তাং ১৮.১০.১৯ইং) দায়ের করেন।
এছাড়া চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে তবারকর আলী ওরফে ইয়াবা সুমনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো হল- সিলেটের বিশ্বনাথ থানার এফআইআর নং ২ (তাং ১.০৪.২০১০ইং), ২৩ (তাং ২৯.০৯.২০১০ইং), ১৯ (তাং ২৫.০৮.২০১১ইং), ২৫ (তাং ২৫.১১.২০১০ইং), ৩ (তাং ৩.১১.২০১২ইং), ১৩ (তাং ২৮.০২.২০১৫ইং), জিডি নং ৫৮ (তাং ২.১২.২০১৪ইং), ৯৯৫ (তাং ২৮.০৯.২০১০ইং), সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার এফআইআর নং ৭ (তাং ১০.১২.২০১৪ইং)।
বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইন-চার্জ শামীম মুসা বলেন, শুধু তবারক কেন? মাদক ব্যবসায় সাথে যেই জড়িত থাকবে, তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। আর ইতিমধ্যে তবারক-সাবিনাসহ গ্রেপ্তারকৃতদের অভিযুক্ত করে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। সাবিনা ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে।
বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম নুনু মিয়া বলেন, মাদক ব্যবসায়ী সাথে যে বা যারা জড়িত থাকবে তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। আর সরকারি গাছ কর্তন করে থাকলে তদন্তসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।