শুক্রবার ● ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২০
প্রথম পাতা » গাইবান্ধা » ভাষা আন্দোলনে গাইবান্ধা
ভাষা আন্দোলনে গাইবান্ধা
সাইফুল মিলন, গাইবান্ধা :: ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে বাংলাকে উপেক্ষা করার অপচেষ্টা শুরু হলো। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শাসকদের অবজ্ঞা তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছিল। এর বিরুদ্ধে ঢাকায় তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ হলো। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ল বাংলার অন্যান্য শহর বন্দর এমনকি গ্রামেগঞ্জে। গাইবান্ধাতেও সেই ঢেউ এসে লাগে। আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।
১৯৪৯ সালের শুরু থেকেই গাইবান্ধায় ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে কিছু কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। এই সময় গ্রামের হাটে বাজারে সভা সমাবেশ করে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে শাসক মুসলিম লীগের চক্রান্তের কথা প্রচার করা হয়। এ কাজে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষক আন্দোলনের নেতাকর্মীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এদের মধ্যে ফুলছড়ি থানার কঞ্চিপাড়ার ডা. কাইয়ুম, কাবিল মিয়া, ডা. ফজলার রহমান, খেজেরউদ্দিন, আফাজউদ্দিন সুন্দরগঞ্জ থানার কছির উদ্দিন, হানিফ ভূইয়া, অমল রায়, কামারপাড়ার বাহার মিয়া, সাঘাটার মজিবর রহমান, ভরতখালীর পোড়াগ্রামের ফরিদুল ইসলাম সোনা, লক্ষীপুরের জসিমউদ্দিন, নলডাঙ্গার আব্দুল খালেক সরকার, গোবিন্দগজ্ঞের মজিবুর রহমান, খোরশেদ মিয়া, শাহ ফজলুর রহমান, গাইবান্ধা শহরের নির্মলেন্দু বর্মন, আব্দুস সোবহান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। স্কুল কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন গাইবান্ধা কলেজের ছাত্র পীরগঞ্জের কাজী আব্দুল হালিম, গাইবান্ধা শহরের স্কুল ছাত্র হাসান ইমাম টুলু, কার্জন আলী, গোলাম কিবরিয়া, সুশীল নন্দী প্রমুখ। একজন অবাঙালি শিবসাগর মাহতো এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গাইবান্ধায় কমিটি গঠন করে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হতো।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়রি ঢাকায় পুলিশের গুলি বর্ষণে হতাহতের সংবাদ পেয়ে গাইবান্ধায় ২২ ফেব্রুয়ারি স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। মিছিল সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়। গাইবান্ধার বিড়ি শ্রমিকরা ঐ আন্দোলনে জঙ্গী ভূমিকা রাখেন। কাজী আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে গাইবান্ধা কলেজের ছাত্ররাও প্রতিবাদ মিছিল করে। মিছিল-সমাবেশে স্লোগান ওঠে-‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই।’ এসময় মুসলিম লীগের সমর্থক গুন্ডারা অনেক হিন্দু ব্যবসায়ীর দোকানে হামলা চালায়। গোটা মহকুমায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মহকুমা শহরের বাইরেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৫২ সালে গাইবান্ধায় প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের কাঠামো ও দায়িত্বপ্রাপ্তরা ছিলেন ঃ সভাপতি মতিউর রহমান, সহসভাপতি-মজিবুর রহমান (গোবিন্দগঞ্জ), খন্দকার আজিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক হাসান ইমাম টুলু, (পরবর্তীকালে আইনজীবী) সদস্য-কাজী আব্দুল হালিম, (পীরগঞ্জ) খান আলী তৈয়ব (পরবর্তীকালে আইনজীবী), শাহ ফজলুর রহমান, (গোবিন্দগঞ্জ), গোলাম মোস্তফা (বল্লমঝাড়) জলিলার রহমান, গোলাম কিবরিয়া, শাহ নুরুন্নবী, বিধু ভূষণ, খোরশেদ মিয়া প্রমূখ। নলডাঙ্গার আব্দুল খালেক সরকার কমিটিতে না থাকলেও জঙ্গী কর্মী ছিলেন। ঐ সময় মুসলিম লীগের সাইদার রহমান, সিরাজউদ্দিন, শাহ আব্দুল হামিদ, খয়রাজ্জামান, মনসুর আলী, আউয়াল খাঁ, আকবর আলী, কাশেম মিয়া, রেফায়েত মিয়া প্রমূখ ভাষা আন্দোলনের তীব্র বিরোধীতা করেন। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গাইবান্ধায় এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগাররা আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হলে সরকার মিথ্যা মামলা দায়ের করতে থাকে। ঐ সময় মতিউর রহমান, হাসান ইমাম টুল, পীরগঞ্জের আব্দুল হালিম, নলডাঙ্গার আব্দুল খালেক সরকার, পলাশবাড়ীর আব্দুর রহিম গ্রেফতার হন। মতিউর রহমান সাত মাস, হাসান ইমাম টুলু চার মাস এবং অন্যরা বিভিন্ন মেয়াদে কারানির্যাতন ভোগ করেন। কারাগারে নির্যাতনের ফলে আব্দুল খালেক সরকার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ঐ সময় রংপুর আদালতে ভাষা সংগ্রামীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এডভোকেট আবু হোসেন সরকার, যিনি পরবর্তীকালে পূর্ববাংলার মূখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।
১৯৫৩ সালে গঠিত দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে সভাপতি ছিলেন খান আলী তৈয়ব ও সম্পাদক ছিলেন কার্জন আলী। এই কমিটি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শামসুল আলম তারা (পরবর্তীকালে দৈনিক বাংলা’র মফস্বল সম্পাদক)। প্রথম কমিটির সকলেই এই কমিটিতেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ৯২(ক) ধারা জারির পর মতিউর রহমান, হাসান ইমাম টুলু ও খান আলী তৈয়ব গ্রেফতার হন। তারা দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। ১৯৫৫ সালে তারা কারামুক্ত হয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করেন। এই পরিষদে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন হন আবু তাহের ইদু।
১৯৫৫ সালে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর উদ্যোক্তা ছিল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি তসলিম উদ্দিন খান এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষে ওয়ালিউর রহমান রেজা (পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও গণপরিষদ সদস্য) ও শামসুন্নাহার বেলী (পরবর্তীকালে গাইবান্ধা সরকারি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক)। মুসলিম লীগারদের বাধার কারণে ঐ বছর শহিদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। খোলাহাটির মহিরউদ্দিন এবং ছাত্রশক্তির নেতা আজিজার রহমান (পরবর্তীকালে গাইবান্ধা কলেজের শিক্ষক) মিছিল নিয়ে এসে নির্মাণ কাজে বাধা দেয়। ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে মধ্যপাড়ার সোহরাওয়ার্দী সড়কে বীরেন বকসীর বাসায় অনুষ্ঠিত এক সভায় গাইবান্ধা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান বরদা নাথ চাকীকে সভাপতি এবং ভাষা সৈনিক আবু তাহের ইদুকে সম্পাদক করে শহিদ মিনার নির্মাাণ কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৫৭ সালে এই কমিটি গাইবান্ধা পৌরপার্কের বর্তমান স্থানে প্রথম শহিদ মিনারের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। রংপুর জেলা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান মশিউর রহমান যাদু মিয়ার পরামর্শে জেলা বোর্ডের গাইবান্ধাস্থ ঠিকাদাররা এই নির্মাণ কাজে আর্থিক সহযোগিতা করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহিদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে।
স্বাধীনতার পর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তে একই স্থানে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক (যিনি পৌরসভার প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন) জায়েদী সাত্তারের উদ্যোগে শহিদ মিনারটি পূণর্র্নিমাণ করা হয়। এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন একাত্তরের শহিদ প্রকৌশলী বদিউল আলম চুনির পিতা বছিরউদ্দিন আহমেদ। ২০১৭ সালে আধুনিক ও সম্প্রসারিত বর্তমান শহিদ মিনারটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। পৌর মেয়র শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবীর মিলনের উদ্যোগে নির্মিত শহিদ মিনারটি ঐ বছরের ১৭ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি এমপি।
তথ্যসুত্র : ভাষা সংগ্রামী মতিউর রহমান, হাসান ইমাম টুলু ও খান আলী তৈয়ব এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ওয়ালিউর রহমান রেজার সাক্ষাৎকার।