শুক্রবার ● ৬ মার্চ ২০২০
প্রথম পাতা » কক্সবাজার » রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে নিষিদ্ধ আরসা’র ক্যালেন্ডার
রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে নিষিদ্ধ আরসা’র ক্যালেন্ডার
পলাশ বড়ুয়া, উখিয়া প্রতিনিধি :: কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে অসংখ্য নিষিদ্ধ সংগঠন স্বগৌরবে প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় রোহিঙ্গার ঘরে শোভা পাচ্ছে নিষিদ্ধ আরসা’র অত্যাধুনিক মেশিনে প্রিন্ট করা ক্যালেন্ডার। এমন দৃশ্য নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। সম্প্রতি বালুখালী ১০ নম্বর ক্যাম্প এইচ ব্লকের প্রায় রোহিঙ্গার ঘরে নিষিদ্ধ রোহিঙ্গা সংগঠন আরসা’র প্রিন্ট করা ক্যালেন্ডার লক্ষ্য করা গেছে। একই চিত্র কুতুপালং ২ ওয়েষ্ট ক্যাম্প, থাইংখালি তাজনিমার খোলা ক্যাম্প-১৩ এর ব্লক-এ-৩ এর রোহিঙ্গা ঝুপড়িতে। তবে কুতুপালংয়ে হাফেজ জালাল আহমদ ক্যাম্প কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আরসার সাংগঠনিক তৎপরতা বেড়ে গেছে এমনটি মনে করছে ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা।
এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), আল-ইয়াকিন, আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউমেন রাইটস (এআরএসপিএইচ), ভয়েস অব আরাকান, ফ্রি রোহিঙ্গা কলিশন, মার্স গ্রুপ, নবী গ্রুপ, মাষ্টার গ্রুপ, আইয়ুব গ্রুপসহ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্প কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছে স্বশস্ত্র এসব রোহিঙ্গা সংগঠন আরসা, আল-ইয়াকিনের সদস্যরাই মিয়ানমারের সেনা চৌকিতে হামলার কারণে সে দেশের সেনারা রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন চালালে তাদেরকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোহিঙ্গারা এও বলছেন এসব নিষিদ্ধ সংগঠন গুলোর কারণে তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কেউ তাদের অবাধ্য হলে ক্যাম্প-৬ এর ‘নৌকা ফিল্ড’ নামক স্থানে নিয়ে গিয়ে টর্চার করা হয়।
সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ক্যাম্পে রয়েছে তাদের নিজস্ব আস্তানা। সেখানে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শুরু করে দেশীয় অস্ত্রের মহড়া চলে নিয়মিত। সন্ধ্যায় ঘনিয়ে এলে পরিবেশ আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। সংঘবদ্ধ এসব নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যদের নেপথ্যে থেকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সাইট ও ব্লক মাঝিদের বিরুদ্ধে।
কুতুপালং ক্যাম্প-৪ এর হেড মাঝি মোহাম্মদ হোছনের সহযোগিতায় আল-ইয়াকিন সদস্য মীর আহমদের ছেলে মো: রফিক আলম (৪০), মীর আহমদের ছেলে জয়নাল উদ্দিন (২৬), শফিক আলম (৪০), এফ-১২ ব্লকের মোহাম্মদ ইসলাম (৪০) ক্যাম্প কেন্দ্রিক হত্যাকান্ড, সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ সব ধরণের অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তবে মৌলভী আয়াজ, মোহাম্মদ মোছা ও আরমান নামে তিনজন এই সংগঠনের শীর্ষ নেতা বলে জানা গেছে।
আবার অনেকেই নিজেদের মতো সংগঠিত করে কুতুপালং ক্যাম্প-৬, বালুখালী ক্যাম্প-৮, ক্যাম্প-১০, তাজনিমার খোলা ক্যাম্প, লম্বাশিয়া ক্যাম্প-১ তেলখোলা, শফিউল্লাহকাটা, ঝুমেরছড়া, শালবাগান, শাপলাপুরসহ আশেপাশের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ সংগঠনের জন্য গোপন মিটিং করে এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটাচ্ছে। এদের মধ্যে মোস্তাক আহমদের ছেলে নবী হোসেনের একটা দল রয়েছে। তার দলেও প্রায় শ খানেক জন সক্রিয় সদস্য আছে। ২৯ সদস্যের মার্স গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে দীল মোহাম্মদ। কলিম উল্লাহ ও সোহেলের আছে ৩০ সদস্যের এফআরসি গ্রুপ। ইউছুপ নেতৃত্ব দিচ্ছে ভয়েস অব আরকানের। এছাড়া মৌলভী শহীদুল ইসলাম, মৌলভী আয়াজ, আলম গ্রুপ ও হাসিম গ্রুপের সদস্যরাও সক্রিয়।
ইতোপূর্বে অনেক ক্যাম্প ইনচার্জদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠলে অনেক ক্যাম্প প্রশাসনের পরিবর্তনও করা হয়। সম্প্রতি সরেজমিন ক্যাম্প ঘুরে জানা গেছে এসব তথ্য ।
সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন ছদ্মবেশে আল-কায়েদার অনুসারী হিসেবে পরিচিতি আনসার আল ইসলাম ও হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী, বাংলাদেশ-এর কিছু সদস্যও কাজ করছে। এদের অনেকে সীমান্তের চোরাই পথে আরকানে গিয়ে নানা অপরাধ করে আসার পথে মাদকের চালান নিয়ে আসছে। যদিও এসব নিষিদ্ধ সংগঠন গুলো আরকানে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ক্যাম্প থেকে উঠতি বয়সী যুবকদের আল-ইয়াকিনে যোগ দিতে চাপ প্রয়োগ করছে।
এদিকে আরসা’র নামে প্রকাশিত ক্যালেন্ডার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাওর হলে শ.ম গফুর সহ কয়েকজন গণমাধ্যমকমী তাঁদের ওয়ালে লিখেছেন, ‘এরা আমাদের মেহমান, এসব কর্মকান্ড কেন ? এসব কিভাবে, কোথায়, কখন প্রিন্টিং সরবরাহ করা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
রোহিঙ্গাদের অপরাধ কর্মকান্ড প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাখ লাখ রোহিঙ্গার ঘনবসতি ও দুর্গম এলাকায় বসতি হওয়ায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাম্প কেন্দ্রিক যে কোন অপরাধ দমণে তাৎক্ষণিক সাড়া দিতে না পারায় এসব নিষিদ্ধ সংগঠন গুলো দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১০ এর সহকারী ক্যাম্প ইনচার্জ ও সহকারী কমিশনার বাবুল সুত্রধর বলেন, এ ধরনের ক্যালেন্ডার পূর্বে থাকলেও এখন নেই। তাছাড়া শুধুমাত্র ক্যালেন্ডার বিষয়ক অভিযান পরিচালনা করারও সুযোগ নেই। অন্য কোন অভিযানের সময় বিষয় গুলো দেখার কথা তিনি জানান।
এ প্রসঙ্গে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মর্জিনা আকতার বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘরে ঘরে নিষিদ্ধ সংগঠন আরসার ক্যালেন্ডারের বিষয়ে কোন তথ্য তাঁর জানা নেই। তবে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষারকারী বাহিনী। একই সাথে নিষিদ্ধ আরসার ক্যালেন্ডারের বিষয়টিও তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
উখিয়া নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের মহাসচিব ও সিনিয়র সাংবাদিক গফুর মিয়া চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় কারণে ক্যাম্পগুলোতে দিনদিন অস্থিরতা বাড়ছে। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদেরকে মানবিক কারণে এদেশের মানুষ আশ্রয় দিলেও রোহিঙ্গারা আমাদের সরলতাকে দুর্বলতা মনে করে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। একই সাথে তিনি ক্যাম্পে কেন্দ্রিক নৈরাজ্য বন্ধে ক্যাম্প প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন।