সোমবার ● ২০ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » করোনা মহামারী-যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে এসেছে
করোনা মহামারী-যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে এসেছে
সাইফুল হক :: আলবেয়ার কামু তাঁর বিখ্যাত ‘দি প্লেগ’ উপন্যাসে লিখেছিলেন ‘বারবার মানুষকে খুব অবাক করে দিয়ে হঠাৎ উপস্থিত হয় যুদ্ধ আর মহামারী’। যুদ্ধের কারণ গোপন বা অপ্রকাশ্য নয়, একেবারে প্রকাশ্য ও স্পষ্ট। সামনে দেখা যায় রাজনৈতিক ও সামরিক কারণ। আর একটু গভীরে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায় অধিকাংশ যুদ্ধেরই মূল বিষয়টা অর্থনৈতিক। কেবল দুই বিশ্বযুদ্ধ নয়, অধিকাংশ যুদ্ধ ও যুদ্ধ প্রচেষ্টার পিছনে রয়েছে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক স্বার্থ; দখলদারিত্বের মধ্য দিয়ে বাজার সম্প্রসারণ; পুঁজির মুনাফার নতুন ক্ষেত্রের বিস্তৃতি। এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ খুবই স্পষ্ট, খুবই নির্দিষ্ট। মহামারীর বিষয়টি একরম নয়। প্রতিপক্ষ অনেকটাই অদৃশ্য, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, অনেক অনুসন্ধান আর গবেষণার মাধ্যমে প্রতিপক্ষ, জীবানু আকারে সক্রিয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীবের সন্ধান করতে হয়। প্রথম দিকে এটা অমাবশ্যার অন্ধকারে কালো বিড়াল খোঁজার মত। মানুষ তার অস্তিত্বের জন্যই অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে নানা গবেষণা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মহামারীর উৎস এসব কালো বিড়াল খুঁজে বের করেছে। নানান নাম দিয়ে এসব জীবানুর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক, প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরী করেছে। উন্নয়ন, অগ্রগতি আর সভ্যতার নামে মানুষ যত এগিয়ে থাকার, বিকশিত হবার ঘোষণা দিচ্ছে ততই নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদেরকে নতুন নতুন মহামারী, জীবানু শত্রুকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। একটার নিয়ন্ত্রণ বা বিনাশ না হতেই আরেকটা এসে হাজির হচ্ছে। এই নিরন্তন যুদ্ধ সভ্যতাকে থমকে দিচ্ছে, উন্নয়ন আর অগ্রগতিকে কখনও কখনও সাপ-লুডুর মত ৯৯ থেকে ২০, ১০ বা শূন্যতে নামিয়ে আনছে। এসব মহামারী বা জীবানু সংক্রমন সমগ্র উন্নয়ন আর অগ্রগতির স্ব-বিরোধীতাকে প্রবলভাবে সামনে নিয়ে আসছে। এই কর্পোরেট সভ্যতার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকে মারাত্মকভাবে তুলে ধরছে। যে প্রক্রিয়া-পদ্ধতিতে এই উন্নয়ন এখন তার আত্মবিনাশী চরিত্র-বৈশিষ্ট্য গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠেছে এই উন্নয়নের নীতি, দর্শন আর কৌশল নিয়ে। হাজারো জিজ্ঞাসা তৈরী হয়েছে একালের মানুষের দৈনন্দিন জীবন, আচরণ, খাদ্যাভাস প্রভৃতি নানা বিষয় নিয়ে। করোনা মহামারী রাষ্ট্র ও সরকারের অগ্রাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী প্রশ্নসমূহকে বড় আকারে সামনে নিয়ে এসেছে। কথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি বা নিছক মুনাফানির্ভর কর্পোরেট অর্থনীতি যে মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারছে না, তার সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমনকি জীবনের উপর তার প্রাথমিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না এবার করোনা দুরযোগে তা আবার প্রমাণীত হোল।কোন কোন রোগ ব্যধি বা অসুস্থতার শ্রেণী পক্ষপাত বা শ্রেণী সম্পৃক্ততার বিষয় নিয়ে নানান আলোচনা থাকলেও স্পষ্টতই করোনা ভাইরাস, কোভিড ১৯ এর মত মহামারীসমূহের বিশেষ শ্রেণী পক্ষপাত দেখা যাচ্ছে না। করোনা ভাইরাসকে রস করে ‘সাম্যবাদী ভাইরাস’ হিসাবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সকল ধরনের নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণবাদী নীতি-কৌশলকে কলা দেখিয়ে করোনা ভাইরাস আন্তঃমহাদেশীয় স্তরে সংক্রমনের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। এই ভাইরাস জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে সংক্রমিত করছে। যে কারণে এই ধরনের ভাইরাস সম্পর্কে কোন রাষ্ট্র বা সরকারের নিস্পৃহ থাকার কোন অবকাশ নেই। আশঙ্কা হচ্ছে পুরো উন্নয়ন দর্শন, জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভাসের গুণগত রূপান্তর ব্যতিরেকে আগামীতে মাঝে মধ্যেই বিশ্বের দেশ ও অঞ্চল নির্বিশেষে মানুষকে এই ধরনের মহামারীর সম্মুখীন হতে হবে। করোনা মহামারীর এবারকার এক গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হচ্ছে- গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেখানে যত এগিয়ে বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ভূমিকা যেখানে যত শক্তিশালী তারা তত দ্রুত এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এনে মানুষকে বাঁচাতে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে পেরেছে। এ কারণে চীন,ভিয়েতনাম ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখাতে পেরেছে। করোনা মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শোচনীয় অবস্থার একটি বড় কারণ বোধ করি এখানে নিহিত। খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসার মত সামাজিক নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহকে মুনাফার বাজারের উপর ছেড়ে দিলে যে মহামারী বা প্রাকৃতিক বড় কোন দুর্যোগে মানুষকে রক্ষা করা যায় না করোনা মহামারী আবারও তা প্রমাণ করেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আবার রাষ্ট্রকেই মিলিয়ন, বিলিয়ন বা ট্রিলিয়ন ডলারের জরুরী অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করে যুদ্ধকালীন আয়োজনে নেমে পড়তে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন বহুল আলোচিত ‘ওবামা হেলথ কেয়ার’ কর্মসূচি বাতিল করলেও বা আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলীয় অন্যতম প্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স এর ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ সুরক্ষার দাবী সম্পর্কে নানা তীর্যক মন্তব্য সত্বেও এখন বাধ্য হয়ে ঘোরাপথে জরুরী চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যখাতে তাকে আরো বহুগুণ বরাদ্দ দিতে হচ্ছে।
এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মত দেশগুলোর অবস্থা আরো শোচনীয়। আবহাওয়া, এই অঞ্চলে মিউটেশনের মধ্য দিয়ে আসা করোনা ভাইরাসের জীনগত পরিবর্তন, এইসব অঞ্চলের মানুষের তুলনামূলক ইমিউনিটি ক্ষমতা প্রভৃতি কথিত কারণে করোনা মহামারী এখনও দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে ভয়ানক আকারে সংক্রমিত না হলেও সত্যি সত্যি যদি এখানে মারাত্মক রূপ নেয় তাকে প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এতদাঞ্চলের রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের নেই। বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোতে গণস্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা বা কার্যকরি স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা বলতে বাস্তবে কিছু নেই। করোনা সংক্রমনের মাত্র ক’দিনেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। প্রতিদিন তার বেহাল দশা দেখা যাচ্ছে। করোনা আতঙ্কে অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডাইগনোস্টিক সেন্টার বন্ধ, ডাক্তার-নার্সরা অনুপস্থিত, সাধারণ বা জটিল রোগের নিয়মিত চিকিৎসা সেবাও একেবারে সীমিত। ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারও অধিকাংশই বন্ধ। অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের অবস্থাও তথৈবচ। করোনার মত মহামারী মোকাবেলায় আমাদের অবস্থা যে কত নাজুক ও ভঙ্গুর গত দুই/তিন মাসে তা খুব খারাপভাবেই ধরা পড়েছে। নানা প্রণোদনা আর হুমকি দিয়েও ডাক্তার ও হাসপাতালসমূহকে কাজে নামানো যাচ্ছে না। মাথাপিছু ডাক্তার আর বাজেট বরাদ্দের দিক থেকে আমাদের অবস্থা শোচনীয়। মাথাপিছু ডাক্তার আর বাজেট বরাদ্দের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। এখানে প্রতি এক হাজার জনের জন্য রয়েছে ০.৫ জন ডাক্তার, নেপালে এই সংখ্যা ০.৭ জন, ভারতে ০.৮ জন, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ১.০ জন। আর বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ গত অর্থবছরে ছিল ৬.৭২ শতাংশ; বর্তমান বাজেটে তা ৬.৫২ শতাংশ করা হয়েছে। গত সপ্তাহ দুই ধরে গণমাধ্যম প্রতিদিন করোনা উপসর্গ নিয়ে ৮/১০ জনের মৃত্যুর খবর দিচ্ছে। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই বলে রোগতত্ত্ব বিষয়ক সরকারি সংস্থা আইইডিসিআর এর সরকারি ঘোষণায় এসব মৃত্যুকে করোনায় মৃত্যু হিসেবে আখ্যায়িত করছে না। এ সংক্রান্ত তথ্য গোপন করার বড়সড় অভিযোগও রয়েছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মত দেশগুলো কিভাবে সামাল দেবে বা কিভাবে কত প্রাণের বিনিময়ে এই মহামারীর সংক্রমণ থেকে বেরিয়ে আসবে তা এখনও অজানা। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে এখানে টেকসই, কার্যকরি ও আধুনিক গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর নেই ;দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রত্যেককে এই গণস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই। এখনকার মুনাফাকেন্দ্রীক, বিশৃঙ্খল, জবাবদিহীতাহীন ও স্বেচ্ছাচারীতার উপর চিকিৎসা ব্যবস্থা ছেড়ে দেবারও কোন অবকাশ নেই। করোনা সংক্রমনের স্বাস্থ্যগত সংকট ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক সংকটে পর্যবসিত হয়েছে। শ্রমজীবী-মেহনতি, দিনমজুর, বস্তিবাসীসহ দিন এনে দিন খেয়ে চলা দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ ইতিমধ্যে গুরুতর বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এখন তাদের কাজ নেই, আয় নেই, খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য নেই। তাদের বিপুল অধিকাংশেরই সঞ্চয় বলে কিছু নেই। তাদের বড় অংশেরই দুই বেলা খাওয়ার সামর্থ্য নেই, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচী, ১০ টাকা দরে চাল বিক্রি বা ত্রাণ তৎপরতা থেকে এই মানুষদের ৬০/৭০ শতাংশ এখনও বঞ্চিত। এই হতদরিদ্র বিশাল জনগোষ্ঠির কাছে অনতিবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থায় খাদ্যসামগ্রী ও নগদ টাকা পৌঁছাতে না পারলে তাদের বেঁচে থাকা যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, তেমনি করোনা ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমন রোধে তাদেরকে ঘরে ধরে রাখা যাবে না। সরকার থেকে নানাভাবে আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে, দেশে কোন খাদ্যসংকট নেই। কিন্তু এই খাদ্যের উপর শ্রমজীবী-দিনমজুরদের যদি অধিকার না থাকে বা তাদের যদি খাদ্য সামগ্রী কেনার সামর্থ্য না থাকে তাহলে দুর্ভিক্ষ অবস্থা সৃষ্টি হবার আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। করোনা সংক্রমনজনীত মহামারী অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে এই আশঙ্কা বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি এড়িয়ে যাবার সুযোগ রয়েছে। কেবল এড়িয়ে যাওয়া নয় আগামীতেও বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার অবকাশ আছে। তার জন্য প্রথম প্রয়োজন হচ্ছে সরকারের বিদ্যমান নীতি-দর্শন-চিন্তা ও অগ্রাধিকারের পরিবর্তন। বাংলাদেশ যদি এখন খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে থাকে (সরকার থেকে এ পর্যন্ত তাই বলা হচ্ছে) তাহলে সেই খাদ্য হয় বিনামূল্যে, না হলে একেবারে স্বল্পমূল্যে দেশের প্রতিটি শ্রমজীবী-দিনমজুর ও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করা; শহর ও গ্রামাঞ্চলে এসব পরিবারের জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু করা এবং নিদেনপক্ষে আগামী ৬ মাস তা চালু রাখা। প্রবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে তার বাস্তবায়নও অসম্ভব নয়। এই ব্যাপারে রাজনৈতিক দল, স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি, শ্রেণী-পেশার নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি এবং তাদের তত্ত্বাবধানে সকল পর্যায়ে গণতদারকি কমিটি করা যেতে পারে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই বিরাট কর্মযজ্ঞের সাফল্যের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন করোনাসৃষ্ট সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো, তেমনি দুরযোগ মোকাবেলায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচন করতে পারব।
লেখক : সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি