রবিবার ● ১৭ মে ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » লকডাউন পরিস্থিতি : বিপন্ন-বিপর্যয়ে পোশাক শ্রমিক
লকডাউন পরিস্থিতি : বিপন্ন-বিপর্যয়ে পোশাক শ্রমিক
স্নিগ্ধা সুলতানা ইভা :: চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরীতে ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লেও বাংলাদেশে প্রথম আক্রান্ত শনাক্ত হয় ৮ মার্চ ২০২০। এরপর থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠক শেষে বিশেষজ্ঞরা যখন বলেছেন ‘সারাবিশ্ব এই মহামারীর ঝুঁকিতে, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়’ তখন সরকার ২৫ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।
২৪ মার্চ ২০২০ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা সাধারণ ছুটির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রয়োজনে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা চালু রাখা যাবে। ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন কিন্তু কারখানা বন্ধের কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত রইলেন। বেতন দেওয়ার বোঝাটা সরকারের মাধ্যমে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে গার্মেন্টস মালিকদের দুই সংগঠন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ‘আরো বড়’ প্যাকেজ দাবি করে বললো ‘বিজিএমইএ’র কারখানা বন্ধের বা খোলার এখতিয়ার নেই। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। এ অবস্থায় কারখানা বন্ধ করা হবে না — জানালেন রুবানা হক। ২৬ মার্চ বিজিএমইএ সরকারী ছুটির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার আহ্বান জানান এবং রুবানা হক বলেন মার্চের বেতন মালিকেরা দেবেন, এপ্রিলের বেতন প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা থেকে দেওয়া হবে।
গার্মেন্টস কর্মীরা ফেব্রুয়ারী মাসের বেতন মার্চের ১০/১২ তারিখে পেয়েছে। কিন্তু ওভারটাইমের কোনো টাকা পায়নি। ১৫ দিন বিনা মজুরিতে কাটলেই শ্রমিকের হাতে আর টাকা থাকে না। গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ ঘোষণা করলেও বেতন হবে কি না তা কেউই জানে না। হাতে টাকা নেই, চারিদিকে করোনা আতঙ্ক। সব মিলিয়ে দিশেহারা শ্রমিক। তাদের তো রেশনের ব্যবস্থাও নেই। মধ্যবিত্তের মতো সঞ্চয় সম্পদ কিছুই নেই। তারপরেও যেসব কারখানা ছুটির আওতায় পড়ল সেই শ্রমিক রিক্ত হস্তে ফিরে গেল গ্রামে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন মার্চ মাসের বেতনসহ আরও ২ মাসের বেতন অগ্রীম দেওয়ার জন্য মালিকপক্ষকে অনুরোধ জানালেও তাতে কর্ণপাত করা হলো না।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় কারখানা বন্ধের কোনো নির্দেশনা ছিল না। বিধায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে কারখানা খোলা যাবে; এই প্রেক্ষিতে যারা পিপিই, মাস্ক, স্যানিটাইজার সহ করোনা প্রতিরোধী সামগ্রী উৎপাদন করছে সেসব কারখানা বন্ধের কোনো নির্দেশনা এল না। শ্রমিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হলো। এর মধ্যেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম সহ বড় বড় শহরগুলো লকডাউন করে দেয়া হলো।
লকডাউন পরিস্থিতিতেই দলে দলে গার্মেন্টস শ্রমিকরা ঢাকার আশেপাশের ও দূরবর্তী জেলা থেকে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে, অটোরিকশায় ও ভ্যানে করে অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় ফিরেন। কারণ তাদের বলা হয়েছিল ফ্যাক্টরি খুলবে এবং তাদের বেতন দেয়া হবে। যে করোনার উদ্বেগ থেকে বাঁচতে তারা শহরের ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে গ্রামে গিয়েছিলেন সেখানেই আবার ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। তাদের ঢাকায় ফেরার অমানবিক দৃশ্য নিয়ে যখন সমালোচনার ঝড় বইল ঠিক তখনই ঢাকা পুরোপুরি লকডাউন করে দেয়া হলো। তাদের ছুটি বাড়ানোর নোটিশ পেলেও তারা গ্রামে ফিরতে পারলেন না। কেউবা আবার পণ্যবাহী পরিবহনের কাপড়ের নীচে, ড্রামের ভিতর নিজেদের ঢুকিয়ে লুকিয়ে ঢাকা ছাড়লেন। কারণ বাসার মালিকরাও এ মুহূর্তে তাদের থাকতে দিচ্ছে না। পোশাক শ্রমিকরা যেন মাঠের খেলোয়াড় তাদের মাঠে ছেড়ে দিয়ে সরকার ও মালিকরা বড় বড় ভবনে বসে খেলা দেখছে। তারা মরলেই কী, বাঁচলেই কী?
২৬ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং পরে মেয়াদ ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পুনরায় ২৬ এপ্রিল কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক আনার জন্য বিআরটিসি’র কাছে বাস বরাদ্দ চান বিজিএমইএ। তারা আরও জানায় ২০ এপ্রিলের মধ্যে সব শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হবে এবং তারা শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো কারখানা লে-অফ ঘোষণা করলে তাদের শ্রমিকদের লে-অফের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সরকারের হুশিয়ারীর পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩৭০টি কারখানার মালিক কোনো বেতন পরিশোধ করেনি। চলমান সংকটের মধ্যেই ৫৫টি কারখানার ২৬ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে।
২৬ এপ্রিল থেকে কারখানায় আসার জন্য বিভিন্ন কারখানার মালিক শ্রমিকদের ফোন দিয়ে তাদের আসতে বলে। কাজ বাঁচানোর তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। ২৬ এপ্রিল থেকে শুধু ঢাকার শ্রমিকদের দিয়ে কিছু কারখানা চালানো হবে। তবে ধীরে ধীরে এখন সবগুলো খুলে দেয়া হয়েছে এবং ৯০%-এর বেশি শ্রমিক নানা ঝুঁকি নিয়েই কারখানায় যোগ দিয়েছে।
সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্যায়ক্রমে চার দফায় সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হলেও পোশাক শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে পেটের তাগিদে কাজে যোগ দিলো। কাজে যোগ দেওয়ার আগে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সব নিয়ম রক্ষার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। কারখানায় ঢোকার সময় সামান্য ডেটল মেশানো পানি, কোনো ক্ষেত্রে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ার পর ভেতরে ঢুকে কোনো রকম শারীরিক দূরত্ব না মেনেই কাজ করে চলছে লাখো শ্রমিক। একটা পোশাক বানানোর পর অন্তত সেটা কম হলেও দশজনের হাতে হাতে ঘুরছে। এতেও সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিটি ফ্লোরে ২০টি করে টয়লেট আছে। সেখানে দশটি পুরুষ এবং দশটি নারী শ্রমিকদের জন্য। এখানেও সংক্রমণ এড়ানো অসম্ভব। কাজ শেষে প্রতিটি কর্মী সেই ঘিঞ্জি বাসায় বাস করছে ৭/৮ জন করে। কোনোটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ২৬ এপ্রিলের পর এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক শ্রমিক সংক্রমিত হয়েছে।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার পরই এখানে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। ঠিক একইভাবে সব জায়গাতেই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। দিন দিন সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এদিকে গার্মেন্টসের উচ্চপদের অফিসাররা মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হেলমেট, পিপিই পরে এসি রুমে বসে সেলফি তুলে ষ্ট্যাটাস দিচ্ছেন ‘সেফটি ফাস্ট’।
আক্রান্ত কর্মীদের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে ডাক্তাররা পর্যন্ত তাদের ধারে কাছে আসছেন না। এভাবে প্রতিটি কারখানায় আক্রান্ত হচ্ছে কর্মীরা। কিন্তু কোনো চিকিৎসা তো দূরের কথা কাজের টাকাও পাচ্ছেন না তারা। উপরন্তু বিভিন্নভাবে তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বেতন কেটে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এপ্রিলে মাত্র ৬০% বেতন দেওয়া হবে। যেখানে সরকারী কর্মচারিরা সাধারণ ছুটির সময় বাড়িতে বসে পূর্ণ বেতন পাচ্ছেন সেখানে পোশাক শ্রমিকদের সাথে করা হচ্ছে বৈষম্যমূলক আচরণ। ব্যবসায়ী দ্বারা পরিবেষ্টিত সরকার শুধু মুনাফা দেখছেন মানুষ দেখছেন না। একটা লাশ হয়তো সরকারের কাছে একটি সংখ্যা কিন্তু তার প্রিয়জনের কাছে পুরো পৃথিবী। সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ঘোষণা যে নেহাতই কথার কথায় পরিণত হয়েছে তা এখন আর অপ্রকাশিত নেই কোথাও। গার্মেন্টস মালিকদের পর এবার সরকার অন্য ব্যবসায়ীদের চাপের কাছেও নতি স্বীকার করেছে।
করোনা বিরোধী এ সময়েও তথ্যের বিপরীতে অপতথ্যের বিশাল রমরমা। সরকারী প্রচারণাও এর ব্যতিক্রম নয়। অপ্রতুল তথ্যের বিষয়টি সঠিক তথ্য ও পর্যাপ্ত তথ্য দিয়ে মোকাবেলা করা যায়। কিন্তু মিথ্যা বাক্য বিন্যাসে আর বানোয়াট বক্তব্যে অপপ্রচার চালিয়ে তারা আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা আড়াল করছে। করোনায় অসহায় মৃত্যু দেখছি। কিন্তু থেমে নেই আমাদের উচ্ছৃঙ্খলতা, হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, লুট, আত্মসাৎ, প্রতিহিংসা পরাণয়তা।
করোনা পরবর্তী সময়ে নতুন বিশ্ব দেখার আশা করছেন সবাই। বিশ্ব নাকি বদলে যাবে। কেমন হবে সেই বিশ্ব? এত মৃত্যু, এত কান্না, এত দীর্ঘশ্বাসে কি আমরা শুদ্ধ হবো? করোনা ভাইরাসের মতো নিমূর্ল হয়ে যাবে এই করোনা ভাইরাসরূপী মানুষগুলো!
করোনা দুর্যোগে গার্মেন্টস শ্রমিকসহ শ্রমজীবী মানুষ আরো একবার এই অমানবিক নিষ্ঠুর রাষ্ট্র, সরকার ও মালিকদেরকে চিনে নিয়েছে।
লেখক : স্নিগ্ধা সুলতানা ইভা, বাংলাদেশ শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর যুগ্ম সম্পাদক।