রবিবার ● ১৩ ডিসেম্বর ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » রাজনীতির আত্মঘাতি নীতি কৌশল-সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ সাইফুল হক
রাজনীতির আত্মঘাতি নীতি কৌশল-সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ সাইফুল হক
দেশ ও দেশের মানুষ এখন বহুমুখী সংকটে জর্জরিত। নানা কায়েমী গোষ্ঠী আবার ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দিয়ে খেতে ব্যস্ত। করোনা দুর্যোগের প্রথম ঢেউ এর বিপর্যয় কাটতে না কাটতেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এর বিপর্যয় শুরু হয়েছে। সরকারি প্রেসজোট অনুযায়ী এখন প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু ৩৫ এর উপর; ভাইরাস সনাক্ত আড়াই হাজারের উপরে। করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসার বেহাল দশা মোটামুটি আগের মতই। চিকিৎসা ও হাসপাতালের উপর অনাস্থা এখনও প্রবল। মারাত্মক না হলে কেউ আর হাসপাতালে চিকিৎসা নেবার ঝুঁকি নিচ্ছেন না। বিপুল অধিকাংশ রোগি ঘরকে হাসপাতাল হিসাবে গণ্য করে বাড়ীতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
অতিমারীর এই সময়কালে রোমহর্ষক দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচারও আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মহামারীর দুর্যোগ এদের জন্য বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে। কেবল এই সময়কালেই সাড়ে তিন হাজার নতুন কোটিপতি পরিবারের জন্ম হয়েছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণ, নারী, শিশু নিপীড়ন ও বলৎকারের মত সামাজিক অনাচার। থেমে নেই সন্ত্রাসী-মাফিয়াদের তৎপরতা। চলছে দখল-জবরদখল ও ভূমি গ্রাসীদের আগ্রাসী তৎপরতা। সবচেয়ে বেপরোয়া এখন বাজার সিন্ডিকেট। মুনাফাখোর অসৎ বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে কোটি কোটি ভোক্তা সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্টাগত। এরা মানুষকে রীতিমত জিম্মী করে ফেলেছে। সরকারের দিক থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে বাস্তবে কার্যকরি কোন উদ্যোগ নেই। সরকারের মধ্যে যেন এই সিন্ডিকেটসমূহ আরেক সরকার, বোঝাই যায় এদের হাত অনেক লম্বা। এরা দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাতে পারে। সরকারের প্রভাবশালী নানা বংশের সাথে এই মাফিয়া সিন্ডিকেট সমূহের আঁতাতের কারণেই এরা এতখানি বেপরোয়া। এরাও বিদ্যমান নৈরাজ্যিক অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করছে এবং রাতারাতি মানুষের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সামাজিক নৈরাজ্যের এই ক্রমবিস্তারে জীবন-জীবিকার সংকটও প্রবল হয়ে উঠছে। দরিদ্র-হতদরিদ্রের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেবড়েছে। আশংকা আগামী ছ’মাসে আরো কয়েক লক্ষ পরিবার নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে আসবে। এদের বড় অংশের উপযুক্ত কর্মসংস্থান নেই; বেকারত্ব-ছন্দ্য বেকারত্ব এদের জীবনকে দুঃসহ করে তুলেছে। চুরি-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি আর দলীয়করণের কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীও অনেকখানি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
এর মধ্যে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিষ্ট শক্তি আবার তাদের নখ দেখাতে শুরু করেছে। ভোটের অধিকার হরণ করে গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে সমাজে চরম দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী শক্তির উত্থানের জমিন তৈরী করে দেয়া হয়েছে। মুক্ত চিন্তা অবরুদ্ধ করে গোটা সমাজ ও দেশকে ক্রমান্বয়ে আরো অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর যত সীমিত ও দুর্বল হয়েছে সমাজে কুপমন্ডুক ও সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শা ও মনন-মানসিকতা ততই বিস্তার লাভ করেছে। সরকার সাপের মুখে চুমো খাওয়া আর ব্যাঙ্গের মুখে চুমো খাওয়ার দ্বি-মুখী নীতি-কৌশল অনুসরণ করে আসছে। এটা স্পষ্ট, যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকার রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে তারা চরম আদর্শহীন-নীতিহীন কৌশল অবলম্বন করেছে। যা দেশের অবশিষ্ট গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো ও সংস্কৃতিকে নষ্ট করে দিয়েছে। সরকারের এই দ্বি-চারী ভূমিকা, মদদ ও প্রশ্রয়ের কারণেই আজ সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিষ্ট শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছে এবং ভাসকর্যের বিরুদ্ধে আস্ফালন দেখাতে পারছে; বঙ্গবন্ধুর ভাসকর্যকেও আঘাত করছে।
বিএনপির জামায়াত আঁতাতকে ব্যনেষ্টি করতে যেয়ে আওয়ামী লীগ-হেফাজত ঘনিষ্ঠতা, হেফাজতের দাবির কাছে মাথানত করে পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস পরিবর্তন, হেফাজত কর্তৃক প্রধান মন্ত্রীর ‘কওমী জননী’ উপাধি লাভ, কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ প্রদানের স্বীকৃতি, হেফাজতকে নানা ধরনের বৈষয়িক ও আর্থিক প্রনোদনা প্রভৃতি নানাভাবে হেফাজতসহ এই মৌলবাদী শক্তিসমূহকে মদদ ও ইন্ধন জুগিয়ে আসছে; তাদেরকে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে বেশ নিরাপদ দূরত্বেই রাখতে পেরেছে। এটা নিশ্চয় সরকার ও সরকারি দলের আতাত দৃশ্যমান একটি সাফল্য। কিন্তু আগুন নিয়ে খেলতে যেয়ে এখন সরকারের পায়ে আগুনের আঁচ লাগতে শুরু করেছে। এদের ঔদ্ব্যত্ব এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এরা এখন বঙ্গবন্ধুর ভাসকর্যের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে; বঙ্গন্ধুর ভাসকর্যকে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার ঘোষনা দিয়েছে। এই অশুভ তৎপরতা এখনই প্রতিরোধ করতে না পারলে এরা এখানেই থেমে থাকবে না; বাড়তে দিলে এরা এদের আসল চেহারা নিয়ে হাজির হতে থাকবে।
ভাসকর্য ইস্যু কেন্দ্র করে সরকার তরফে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটাবার চেষ্টা চলছে তা একদিক থেকে সরকারকে লাভবান কর।ে এই ইস্যু যত প্রলম্বিত হবে সরকারের কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন তত আড়ালে রাখা যাবে; ভোটাধিকারসহ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্নসমূহ, দুর্নীতি-দুর্বাত্তায়ন, সামাজিক নৈরাজ্য, খাদ্য-বেকারত্বসহ জনগণের বেঁচে থাকার ইস্যু এবং এসব কেন্দ্র করে সরকার বিরোধী গণআন্দোলন-গণসংগ্রামের সম্ভাবনা দুর্বল ও ছত্রভংগ করে রাখা যাবে। এই অবস্থায় আমজনতা ‘পা না ধরে, লাঠি নিয়েই’ টানাটানি করতে থাকবে। এ কারণে মৌলবাদী শক্তির বর্তমান তৎপরতার পিছনে সরকারের কোন মহলের প্র্ছন্ন ইংগিত বা পরিকল্পনা রয়েছে কিনা-এই প্রশ্নও ইতিমধ্যে নানা যায়গা থেকে উঠে এসেছে।
বিদ্যমান ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি যদি আবারও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষবাবে এই কৌশলী ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সমূহ সর্বনাশ। পরিবর্তনকামী প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঠেং বাদ দিয়ে লাঠি ধরে টানাটানি করে লাভ হবে। জনগণের ভোটাধিকারসহ আশু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দাবিসমূহের ভিত্তিতে কর্তৃত্ববাদী শাসন বিদায় দেবার লড়াইয়ে শ্রম ও মনযোগ নিবন্ধ করা প্রয়োজন। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিসর যত বৃদ্ধি পাবে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে গণচেতনাও তত বৃদ্ধি পাবে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশে সমাজের নানা যায়গা থেকে উত্থিত ইস্যুসমূহ কিভাবে মীমাংসা করা যাবে তাঁর গণতান্ত্রিক পথও নিশ্চয় খুঁজে বের করতে হবে।