শুক্রবার ● ২৫ ডিসেম্বর ২০২০
প্রথম পাতা » ঝালকাঠি » ঝালকাঠিতে মুক্তিযোদ্ধার নামে ঘর পাওয়ার আবেদন করেছেন গেজেট বাতিল হওয়া সুলতান
ঝালকাঠিতে মুক্তিযোদ্ধার নামে ঘর পাওয়ার আবেদন করেছেন গেজেট বাতিল হওয়া সুলতান
গাজী মো.গিয়াস উদ্দিন বশির,ঝালকাঠি প্রতিনিধি :: প্রকৃত বীরমুক্তিযোদ্ধার ওসমানী সনদ কেড়ে নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠাকারী ঝালকাঠির সুলতান দুয়ারীর গেজেট ও ভাতা বাতিল হওয়ায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সুলতান হোসেন মাঝির স্ত্রী ও সন্তানদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন সুলতান দুয়ারী। এমনকি অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণের আবেদন ফরম পূরণেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, সদর উপজেলার নেহালপুর গ্রামে তাঁর পাকাঘর (বিল্ডিং) থাকা সত্ত্বেও পুরোনো কাঠের ঘর দেখিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন । সুলতান দুয়ারীর স্ত্রী একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারীশিক্ষক এবং ছেলে একটি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। তবুও তিনি নিজেকে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে ঘর পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধ না করেই মুক্তিযোদ্ধা বনে যাওয়া সুলতান আহম্মেদ দুয়ারী পুরনো কাঠের ঘরের পাশেই একটি নতুন পাকা বিল্ডিং নির্মাণ করেছেন। নতুন পাকা বিল্ডিং পাওয়ার আশায় বিল্ডিং এর কাজ অসমাপ্ত করে রেখেছেন। এ ব্যাপারে তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে প্রতারণার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন ঝালকাঠি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবেকুন নাহার।
এদিকে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা পিপলিতা গ্রামের মৃত সুলতান হোসেন মাঝির স্ত্রী ফরিদা বেগম তাঁর স্বামীর নাম গেজেটভুক্ত করার দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন। গত বুধবার তিনি জেলা প্রশাসকের এ আবেদন জমা দেন। ফরিদা বেগম অভিযোগ করেন, নেহালপুর গ্রামের অমুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহম্মেদ দুয়ারী তাঁর স্বামী পিপলিতা গ্রামের সুলতান হোসেন মাঝির ওসমানি সনদ নিয়ে আর ফেরত দেননি। ওই সনদ দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজের নাম ও বাবার নাম সংশোধন করতে পারলেও গ্রামের নাম সংশোধন করতে পারেননি। এখন তিনি পিপলিতা গ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করেন। অথচ ওই ঠিকানা প্রকৃত বীরমুক্তিযোদ্ধা সুলতান হোসেন মাঝির। প্রতারক সুলতান দুয়ারীর গেজেট ও ভাতা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তাঁর সকল আর্থিক সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর পরেও তিনি নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাদের হয়রানি হয়রানি করছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে যারা সহযোগিতা করছেন, তাদের নামেও মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে সম্মানহানির চেষ্টা করছেন প্রতারক সুলতান দুয়ারী। তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ফরিদা বেগম।
ফরিদা বেগম বলেন, আমি তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার স্বামীর মৃত্যুর পরে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছি। তাই আমার স্বামীর নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।
জানা যায়, ঝালকাঠি সদর উপজেলার নেহালপুর গ্রামের মৃত সৈয়দ আলী দুয়ারীর ছেলে মো. সুলতান আহম্মেদ দুয়ারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করেও দীর্ঘ দিন ধরে মুক্তিযোদ্ধার ভাতাসহ যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন। পাশ্ববর্তী পিপলিতা গ্রামের মৃত. সৈয়জদ্দিনের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা সুলতান হোসেন মাঝির সঙ্গে নাম মিল থাকায় জালিয়াতি করে সনদ নেন সুলতান আহম্মেদ দুয়ারী। অথচ জাতীয়পরিচয়পত্র এবং জমির দলিলে তার নাম সুলতান আহম্মদ দুয়ারী হলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুযোগ সুবিধা নিতে তিনি সুলতান হোসেন সেজেছেন ।
অভিযোগ রয়েছে, সুলতান হোসেন মাঝির কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে ভাতা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে সুলতান আহমেদ দুয়ারী নিজের নামে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা করিয়ে নেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন তিনি। সন্তানদের মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় দিয়েছেন চাকরিও দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী নেহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাঁর গেজেট ও সনদ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সুলতান হোসেন মাঝি ২০১৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী ফরিদা বেগম, ছেলে মিজানুর রহমান, মিরাজ মাঝি, নুবীন মাঝি ও মেয়ে নুপুর বেগম। জীবীত অবস্থায় প্রতারক সুলতান আহম্মেদ দুয়ারীর সঙ্গে শক্তি ও বুদ্ধিতে পারেননি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। নিজের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেননি তিনি। পরিবারের দাবি, তাঁর নামে গেজেট করে স্ত্রীর নামে ভাতার ব্যবস্থা করা হোক।
জানা যায়, সুলতান হোসেন দুয়ারীর মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ বাতিল বাতিল হওয়ায় আর্থিকসহ সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করার জন্য সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নোটিশ দেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট অধিশাখার উপসচিব রথীন্দ্রনাথ দত্ত। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৪৮তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সৈয়দ আলী দুয়ারীর ছেলে সুলতান হোসেন দুয়ারীর মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ বাতিল করা হয়। উপসচিব রথীন্দ্রনাথ দত্ত গত ২২ নভেম্বরে স্বাক্ষরিত চিঠিটি ১ ডিসেম্বর ঝালকাঠিতে পৌঁছলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবেকুন নাহার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। সুলতান আহম্মেদ দুয়ারীর আপন চাচা বয়জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি আকরাম আলী দুয়ারী (৯১) বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা বাড়িতেই ছিলাম। সুলতান আহম্মেদ আমার বড় ভাইয়ের ছেলে। তখন ওর বয়স ১৭-১৮ হবে। সে কখনো মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি। পিপলিতার সুলতান হোসেন মাঝির সার্টিফিকেট নিয়ে কেমন কেমন করে যেন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে। সুলতান মাঝী অশিক্ষিত হওয়ায় সুলতান আহম্মেদ দুয়ারীর সাথে আর পারে নাই।
সুলতান আহম্মেদ দুয়ারীর বাল্যবন্ধু আবদুল হক তালুকদার বলেন, সুলতান আহম্মেদ দুয়ারী আমার চেয়ে এক থেকে দেড় বছরের বড়। ছোটবেলা থেকেই আমরা একত্রে খেলাধুলা করতাম এবং স্কুলে যেতাম। দেশ স্বাধীনের সময়ও আমরা একত্রেই ছিলাম। ও কোন যুদ্ধে যায়নি। কয়েকবছর পূর্বে শুনি সুলতান দুয়ারী মুক্তিযোদ্ধা। এ ছাড়াও নেহালপুরের প্রবীণ ব্যক্তি হাবিবুর রহমান তালুকদার, সুলতান দুয়ারীর চাচাতো ভাই আলতাফ হোসেন, মো. আমির হোসেনসহ এলাকাবাসী জানান, সুলতান দুয়ারী কখনোই কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। সে পিপলিতা গ্রামের সুলতান হোসেন মাঝির সার্টিফিকেট ব্যবহার করে বাবার নাম ভুল হয়েছে বলে পরিবর্তন করে এখন নতুনে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। তিনি জালজালিয়াতি অনেক দক্ষ। এলাকার বিভিন্ন নিরীহ জনের জমি জাল স্বাক্ষর করে দলিল তৈরি করে দখল করে। এর প্রতিবাদ করলে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রাণি করে। এলাকাবাসীর দাবি গত ১৫ বছরে সুলতান দুয়ারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন, তা আদায়ে এখন মামলা করা উচিত ।