রবিবার ● ২৪ জানুয়ারী ২০২১
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » ঝুঁকিতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা
ঝুঁকিতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা
আব্দুল্লাহ আল মাসুম :: সাংবাদিকদের উপর হামলা, মামলা, অশিক্ষিতদের সাংবাদিক কার্ড ঝুলিয়ে চাঁদাবাজী, টাকার জোরে পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক হয়েই বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আজ বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
লাঠিয়ালের বদলে গণমাধ্যম পুষছে কালো টাকার মালিকরা। অতীতে কেউ কালো টাকার মালিক হলে বা অনেক শত্রু থাকলে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী তৈরী করত। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই লাঠিয়ালের জায়গা করে নিয়েছে সংবাদ মাধ্যম। এখন ভূমি দস্যুরা সংবাদ মাধ্যম পুষে, দূর্ণিতি গ্রস্ত রাজনীতিবিদরা সংবাদ মাধ্যম পুষে, যে কোন কালো টাকার মালিকই আর কিছু না হোক লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে একটি হলেও সংবাদ মাধ্যম পুষে। সেটা যেমন হতে পারে টেলিভিশন, পত্রিকা নয়তো ন্যূন্যতম হলেও একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম।
আর কেউ যদি এই সবের বাইরে নিজস্ব চেষ্টায় কোন ছোট গণমাধ্যম চালায় নৈতিকতার ভিত্তিতে। তার নামে নেমে আসে মিথ্যা চাঁদাবাজীর মামলা, সন্ত্রাসী হামলা, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলাসহ বিভিন্ন ভাবে হয়রানী করা হয়।
বিভিন্ন কারণে সাংবাদিকদের উপর ক্ষোভের কারণে হামলার স্বীকার হচ্ছে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকরা। এছাড়া যখন কোন কারণে কোন সাংবাদিককে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, তার উপরও চালানো হয় নির্দয় হামলা।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে বাংলাদেশে৷ আর সে কারণে সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে রয়েছে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকরা। গত বছর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের সময় রাজধানীর জাফরাবাদে দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হয়েছিলেন সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন। ইতিপূর্বে নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া ছাত্র আন্দোলনের সময় সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা বাংলাদেশে সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় টেবিলে নিয়ে এসেছিল৷সপ্তাহব্যাপী চলা ওই ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ৪০ জনেরও অধিক সংবাদকর্মী আহত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছিল বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ইউকে ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’৷ সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, আহত ৪০ জন সংবাদকর্মীর মধ্যে ২২ জন ফটো সাংবাদিক ও চারজন নারী সাংবাদিক আছেন৷ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হওয়া দ্য ডেইলি স্টার-এর সাংবাদিক সুস্মিতা পৃথা ‘আর্টিকেল ১৯’-কে জানিয়েছিলেন, তিনি ফুটওভার ব্রিজ থেকে একটি মিছিলের ছবি তুলতে গেলে মিছিলে আংশগ্রহণকারীদের কয়েকজন অস্ত্র হাতে তাঁকে ধাওয়া করে৷ শুধু তা-ই নয়, তারা তাঁকে আটকে রেখে মিছিলের ছবিগুলো মুছে ফেলতে বাধ্য করে৷ অস্ত্রধারীরা এ সময় তাঁকে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করাসহ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে বলেও জানান পৃথা৷ইতিপূর্বে বরিশালের পুরাতন বিউটি হলের সামনে ডিবি পুলিশের এক অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন স্থানীয় সাংবাদিক সুমন হাসান৷
অভিযানের বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বাকবিতণ্ডা হয়৷ এক পর্যায়ে পুলিশ তাঁকে নির্যাতন করা শুরু করে৷ বেধড়ক মারধরের পর তাঁর অণ্ডকোষ চেপে ধরা হয়৷ তখন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন৷ পরে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার পর জ্ঞান ফিরে এলে আবারো নির্যাতন করা হয় তাঁকে৷
এর আগে সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল ছবি তোলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান৷
গত বছর নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ দিন পর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার আলোচিত ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। গত বছর ১১ই মার্চ পুরনো ঢাকার চকবাজার এলাকায় বাসা থেকে বের হয়েই নিখোঁজ হয়েছিলেন শফিকুল ইসলাম কাজল। তিনি নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ দিন পর গভীর রাতে যশোরে বেনাপোল সীমান্তের একটি মাঠ থেকে তাকে উদ্ধার করার কথা বলা হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে।
তখন এই সাংবাদিককে দুই হাত পেছনে দিয়ে হাত কড়া লাগিয়ে আদালতে নেয়ার ছবি ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছিল। এরপর হাইকোর্ট থেকে জাবিন পেয়ে প্রায় ৯ মাস পর বাড়ী ফিরতে পেরেছিলেন শফিকুল ইসলাম কাজল। তবে তিনি নিখোঁজ হওয়ার আগেই গত বছর ১০ই মার্চ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর সাংবাদিক কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায়। যুব মহিলা লীগের দু’জন নেত্রীও তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দু’টি মামলা করেছিলেন।
কয়েকটি মামলায় গত বছর তেসরা মে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। গত বছর ১৭ই ডিসেম্বর হাইকোর্ট দু’টি মামলায় তাকে জামিন দিলে তার মুক্তির সুযোগ তৈরি হয়। পক্ষকাল নামে একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল একই সাথে দৈনিক খবরের কাগজ বণিক বার্তার আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করতেন।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আরো হুমকির মুখে পড়েছে এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথ ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে৷
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বালাদেশের অবস্থান ১৮০ টি দিশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১৷
বাংলাদেশ যে শুধু পিছিয়েছে, তা-ই নয় প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে, এমনকি মিয়ানমারের চেয়েও। তালিকায় ৬৭ নম্বরে থাকা ভুটান এ অঞ্চলে মুক্ত সাংবাদিকতার শীর্ষে। এরপরই আছে মালদ্বীপ, দেশটির অবস্থান ৭৯। তালিকায় মিয়ানমারের অবস্থান ১৩৯, ভারত ১৪২, পাকিস্তান ১৪৫, শ্রীলঙ্কা ১২৭, নেপাল ১১২ এবং আফগানিস্তান ১২২। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে রাজনীতি করা যত কঠিন হয়ে উঠেছে, সংবাদপত্রে স্বাধীনতার লঙ্ঘনও তত বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ও এর নেতৃত্ব ২০০৯ সাল থেকে যে কঠোর পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, তার শিকার সাংবাদিকরা। ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয়। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকরা হামলার শিকার হন, ইচ্ছে হলেই ওয়েবসাইট বন্ধ, সরকারের সংবাদ সম্মেলনে দেশের দুই শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে অংশ নিতে না দেওয়া এর কিছু উদাহরণ।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ সমর্থক ও এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ১০ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা চালান। সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ‘নেতিবাচক প্রচারণা’র দায়ে এই আইনে ১৪ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। জেল-জরিমানা এড়াতে ও সংবাদমাধ্যমের বন্ধ হয়ে যাওয়া এড়াতে, সম্পাদকরা নিজে থেকেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছেন। এই প্রবণতা এখন তীব্র।
স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে আরেক প্রতিবন্ধক উগ্র মৌলবাদীরা। তারা সাংবাদিক ও ব্লগারদেরও হয়রানি করেই ক্ষান্ত হননি, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে থাকা মানুষকে হত্যা পর্যন্ত করেছেন। গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক এ সংস্থাটি বলছে, ২০১২ সালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের তুলনামূলক অবস্থান ছিল ১২৯৷ পরে ২০১৩ সালে দেশটির অবস্থান নেমে দাঁড়ায় ১৪৪তম অবস্থানে৷ আর ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দেশটির অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১৪৬ ও ১৪৪তম৷ একই কথা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউস৷ সংস্থাটির ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ‘আংশিক স্বাধীনতা’ ভোগ করছে বলে জানানো হয়৷
কেন হামলা হয় সাংবাদিকদের উপর
শুধু বাংলাদেশে নয়, পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশেই সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটছে৷ বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে যেখানে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি, সে দেশগুলোতে সাংবাদিকদের উপর প্রায়ই হামলার ঘটনা ঘটে থাকে৷
জনগণের জন্য নিয়োজিত এই পেশাজীবীদের উপর কেন হামলা হয় এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘সাপ্তাহিক’-এর সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর হামলা নতুন কোনো ঘটনা নয়৷” তাঁর কথায়, ‘‘সরকার কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনগণের কোনো দাবি-দাওয়া বা সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে নয়, বরং পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের দ্বারা দমন-পীড়নের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে চায়৷ পেশাগতভাবেই সাংবাদিকরা এসব দমন-নিপীড়নের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরেন৷ সরকার যা চাপা দিতে চায়, সাংবাদিকরা তা প্রকাশ করে দেন৷ এতে ক্ষিপ্ত হয় সরকার৷” সাংবাদিকদের এ পেশাগত আচরণের কারণেই পুলিশ কিংবা দলীয় কর্মীরা সাংবাদিকদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের উপর হামলা চালায় বলে মন্তব্য করেন গোলাম মোর্তোজা৷এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক খ. আলী আর রাজী বলেন, ‘‘অপকর্ম যেন কখনো প্রকাশিত না হয় সে পথটি নিশ্চিত করতেই সাংবাদিকদের উপর হামলা হয়৷ বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর হামলার ইতিহাস নতুন নয়৷ এক্ষেত্রে নতুন বিষয়টি হলো যে, সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা বাড়ছে৷” কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে সাংবাদিকতার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো নাগরিক সাংবাদিকতা৷
সাংবাদিকতার বহুমুখী এ বিস্তারের ফলে সাংবাদিকরা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতার অপব্যবহারকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে আগের চেয়ে অনেক বেশি৷ ফলে সাংবাদিকদের উপর হামলার সংখ্যাও বাড়ছে৷” তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকের কাজ হলো ক্ষমতার অপব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা৷ কিন্তু যখনই এ কাজটি তাঁরা করতে চাইছেন, তখনই আক্রান্ত হচ্ছেন৷
কীভাবে নিরাপত্তা দেয়া যেতে পারে সাংবাদিকদের
সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন মূলত তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়৷ তাঁদের পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি তাই সারা বিশ্বেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়৷ বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে – এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম মোর্তোজা বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি মূলত রাষ্ট্রের চলমান রাজনৈতিক পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত৷ একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি৷তবে আইনগত নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশে সাংবাদিকতা চর্চায়ও পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন আর রাজী৷তিনি বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের শক্তি অর্জন করতে হবে জনগণের কাছ থেকে৷
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা অনেকটাই রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে গেছে, জনগণের সাথে তাঁদের সম্পৃক্ততা ধীরে ধীরে কমে আসছে৷ সাংবাদিকতা যদি সাধারণ মানুষের নিবর্তনের চিত্র তুলে ধরতে না পারে, তাহলে জনগণ তাঁদের কথা বলবে না৷ পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা তখন দূর্বল হয়ে পড়বে, হুমকির মুখে পড়বে এ পেশাটি৷”
বাংলাদেশে সাংবাদিকরা যেসব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন নানা নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা৷ প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন৷ আরও আছে মামলার ভয়৷ সবসময় পাশে থাকে না প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো৷
মফস্বলের সাংবাদিকতা
এই আক্রোশের চিত্র কতটা বদলেছে, তা জানতে যোগাযোগ করা হয় প্রথম আলোর সাংবাদিক টিপু সুলতানের সঙ্গে৷ পেশাগত দায়িত্ব পালন করার ‘অপরাধে’ ২০০১ সালের ২৫ জানুয়ারি ফেনীতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর নেতৃত্বে তাঁর ব্যক্তিগত সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা টিপু সুলতানকে নির্মমভাবে পেটায়৷ হাত-পা গুঁড়িয়ে দেয়৷ এত বছর পর এখনো তাঁকে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা নিতে হয়৷ ‘‘অবস্থা খুব একটা পাল্টায়নি,” টেলিফোনে বলছিলেন টিপু৷ ‘‘একটা সময় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে চরমপন্থিদের ব্যাপক উৎপাত ছিল৷ তাদের হামলায় মারাও গেছেন কোনো কোনো সাংবাদিক৷ আহত হয়েছেন অনেকে৷ সে ধরনের পরিস্থিতি এখন আর নেই৷ কিন্তু সাংবাদিকদের ওপর চাপ অব্যাহত আছে,”জানান টিপু সুলতান৷তিনি মনে করেন, মফস্বলের সাংবাদিকতা এখনো কঠিন৷
‘‘মফস্বলে দু’ধরনের সাংবাদিক আছেন৷ এর মধ্যে যারা প্রকৃতই সাংবাদিকতা করতে চান তাঁদের ওপর সব রকমের চাপ রয়েছে৷”টিপু সুলতান বলেন, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রশাসনের যারা অন্যায় বা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত সবার আক্রোশের শিকার হন মফস্বলের সাংবাদিকরা৷ ‘‘এখন সাংবাদিক হত্যা বা শারীরিক নির্যাতনের সংখ্যা হয়তো কমেছে, কিন্তু মিথ্যা মামলা দেয়ার ঝুঁকি রয়েই গেছে৷ এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তো তাদের জন্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র,” মন্তব্য টিপুর৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন খড়গ
গেল কয়েক বছরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ও পরবর্তীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক হয়রানির ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো৷ ২০১৫ সালে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখালেখির কারণে সিনিয়র সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করা হয়৷ পরে অবশ্য মামলা তুলে নেয়া হয়৷ গত বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে ২৩ জন সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার শিকার হয়েছেন৷২০১৭ সালের ৩ জুলাই ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার পর যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার নাজমুল হোসেনসহ চারজনের বিরুদ্ধে দিনাজপুরে ৫৭ ধারায় মামলা হয়৷ ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাবার সময় একজন বিচারক যাত্রাপথে যে সুবিধা পাচ্ছেন এবং অন্য সাধারণ মানুষ যেভাবে যাচ্ছে, সে বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন নাজমুল তাঁর স্ট্যাটাসে৷ তাতেই সংক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়৷পরবর্তীতে সেই মামলাটি তুলে নেওয়া হয়।
আলাপকালে নাজমুল জানান, ‘‘আসলে মামলার পর অনেক সাংবাদিকসহ দু’একজন মন্ত্রী আমার পাশে দাঁড়ান৷ তাই এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে” ৷তবে নাজমুল মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই ধারাসহ ব্রিটিশ আমলের বেশ কিছু আইন এবং বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কয়েকটি ধারা অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে৷ ‘‘অনেকেই এগুলোর অপব্যবহার করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন, যেটি খুবই উদ্বেগের বিষয়,” বলেন তিনি৷ব্যক্তিগত আক্রোশের জায়গা থেকে অনেকেই এমন করতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন নাজমুল৷ তবে তিনি স্বীকার করেন, অনেকের ক্ষেত্রে হয়রানির মাত্রা অনেক বেশি হয়৷
কার পাশে কে দাঁড়াবে
একাত্তর টিভির সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনও মনে করেন, নির্যাতিত সব সাংবাদিক সমান মনোযোগ পান না৷ এই বিভাজন মানতে পারেন না তিনি৷ ‘‘প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলো কার পাশে দাঁড়াবে সে বিষয়টি অনেক সিলেক্টিভ৷ সাংবাদিক হিসেবেই যে পাশে দাঁড়াবে তা হয় না,” বলছিলেন নাদিয়া৷
২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ‘নারী’ বলে হামলার শিকার হন তিনি৷নাদিয়ার মতে, সমাজে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা আছে, যার কারণে মানুষ পক্ষে, বিপক্ষের বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না৷
‘‘পক্ষে, বিপক্ষের বাইরেও যে বস্তুনিষ্ঠতা বলে একটি বিষয় আছে, তা যেন সমাজ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে৷ সংবাদ বিপক্ষে গেলে সেটা মেনে নেয়ার মানসিকতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে৷ এমন চলতে থাকাটা সমাজের জন্য ভয়ংকর৷”২০১৩ সালের ঘটনার পর তাঁর পেশাগত কাজের ধারায় তেমন কোনো পরিবর্তন না এলেও তিনি মনে করেন, এখন ‘ঝুঁকির’ বিষয়টি মাথায় নিয়েই কাজ করতে হয়৷ ‘‘আতঙ্ক কাজ না করলেও একটু এগিয়ে গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করছি৷” নাদিয়া মনে করেন, শুধুমাত্র সাংবাদিকদের একক প্রচেষ্টা ও আগ্রহের কারণে সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা এখনো বজায় আছে৷ মালিকপক্ষ কিংবা রাষ্ট্রের নানা যন্ত্রের চাপ নিয়ে তাঁরা নিজেদের আগ্রহে কাজ করে যাচ্ছেন৷
সেল্ফ সেন্সরশিপ
একটু এগিয়ে গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে নাদিয়ার ‘সাবধানতা সাংবাদিকতা’ সর্বত্রই বিরাজ করছে বলে মনে করেন টিপু সুলতান৷ তিনি বলেন যে, প্রভাবশালী মহলের চাপে পড়ে অনেক সময় সাংবাদিকরাই সেল্ফ সেন্সরশিপ অবলম্বন করেন৷
‘‘আমি এমন অনেক ঘটনাই জানি যে, মফস্বলের অনেক সাংবাদিক ভয়ে কিংবা বিপদে না পড়ার জন্য অনেক সংবাদ করতে পারেন না৷ শুধু মফস্বলে কেন, এটা ঢাকাতেও হয়৷ প্রতিটি গণমাধ্যমেই কমবেশি হয়৷ এমনকি মফস্বলের সাংবাদিক হয়তো পাঠালেন, কিন্তু নানা কারণে হয়তো তা ছাপানোই হয় না,” বলছিলেন টিপু৷‘‘বাংলাদেশের দু’টি স্বনামধন্য পত্রিকার বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া হলো৷ দেশীয় কোনো গণমাধ্যম তা নিয়ে সেভাবে রিপোর্ট করেছে? মানুষ তা জানতে পারছে বিদেশি সংবাদমাধ্যম থেকে,” মন্তব্য তাঁর৷তিনি মনে করেন, সার্বিকভাবে সাংবাদিকতার পরিস্থিতি উন্নয়নে সাংবাদিক নেতারাও ভূমিকা রাখতে পারছেন না৷
সাংবাদিকদের দলাদলি
অন্যান্য পেশার মতো রাজনৈতিক কারণে সাংবাদিকরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন এই তিন সাংবাদিক৷ ‘‘সাংবাদিকদের এই দ্বিধাবিভক্তির কারণে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের চাপ আগে যতটা ছিল, এখন তার থেকে বেশি হবার সুযোগ তৈরি হয়েছে,” বলে মনে করেন টিপু সুলতান৷ ‘‘মূলত রাজনৈতিক কারণেই এটি হচ্ছে৷ কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগত সুবিধাও নিয়েছেন৷ কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন৷ কিন্তু খুব ক্ষীণ কণ্ঠে৷”এই পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে শঙ্কা তাঁর৷ নাদিয়াও মনে করেন, সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠনগুলো সাংবাদিকদের কল্যাণে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না৷ ‘‘নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আমরা কাজ করছি৷ শারীরিক নিরাপত্তার অভাব তো আছেই, প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি দেয়া হয় না, চাকরির নিরাপত্তার অভাব, এসবের মধ্য দিয়েই নানান বাধা উপেক্ষা করে আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়,” বলেন নাদিয়া শারমিন৷
সাংবাদিকদের কোন সাপোর্ট সিস্টেম নেই
আইনের দীর্ঘসূত্রিতা, জটিল বিচারিক প্রক্রিয়া সেইসঙ্গে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান পক্ষ থেকে কোন ধরণের সহযোগিতা না থাকার কারণে সাংবাদিক নির্যাতন ও সহিংসতা থামানো যাচ্ছেনা। সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় কোন প্ল্যাটফর্ম না থাকায় এই পেশা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।”সাংবাদিক নির্যাতনের মামলাগুলো দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখা হয়।
একের পর এক তারিখ পড়তে থাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত আইনগুলোয় সাংবাদিকদের সুরক্ষার কথা সেভাবে বলা নেই। এ কারণে তারা দ্রুত বিচার পান না। এছাড়া তাদের কোন সাপোর্ট সিস্টেম নেই যারা তাদের এসব সমস্যা নিয়ে কথা বলবে।
আইনি লড়াই করতে চান না সাংবাদিকরা
এসব কারণে অনেক সময় দেখা যায় সাংবাদিকরা নির্যাতন, হয়রানি বা হুমকি-ধমকির শিকার হলেও বিষয়গুলো নিয়ে আইনি লড়াই করতে চান না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা প্রভাবশালীদের চাপের মুখে স্থানীয়ভাবে বিষয়গুলো মীমাংসা করে ফেলেন।
“সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হলেও সেগুলো আদালতে নিতে চান না। কেননা মামলা করতে গেলে প্রতিষ্ঠান থেকে যে সাপোর্ট লাগে বা অর্থনৈতিকভাবে যে সাপোর্ট লাগে, সেটা তাদের সবার থাকেনা। এ অবস্থায় বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়।
১৯৯৬ সালে সাপ্তাহিক নীল সাগর এর প্রতিবেদক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, নির্বাচন ফলাফল পরবর্তী সহিংসতার সংবাদ সংগ্রহকালে নিরাপত্তা কর্মীর গুলিতে নিহত হন। পরবর্তী সময় প্রতিবছর এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন নাম। সাইফুল আলম, মীর ইলিয়াস হোসাইন, শামসুর রহমান, নাহার আলি, হারুনুর রশিদ, শুকুর হোসাইন, সৈয়দ ফারুক আহমেদ, মানিক সাহা, হুমায়ন কবির বালু , কামাল হোসেন, দিপঙ্কর চক্রবর্তি, শহীদ আনোয়ার, শেখ বেলাল উদ্দিন, গোলাম মাহফুজ, গৌতম দাস, বেলাল হোসেন, ফরহাদ খা, গোলাম মোস্তফা সারোয়ার, মেহেরুন রুনি, অনন্ত বিজয় দাস, জামাল উদ্দিন, আলহাদ আহমেদ, দেলোয়ার হোসেন, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, মিশিউর রহমান এবং সর্বশেষ সমকালের সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল ৩ রা ফেব্রুয়ারি ২০১৭ নিহত হন।
পেশাগত অনিশ্চয়তা
বলাই হয়, সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। কেন ঝুঁকিপূর্ণ? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে- এখানে জীবন-জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, মহামারী যা-ই হোক, একজন সরকারি কর্মচারী মাস শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ পান। চাকরি শেষে অবসরকালেও তারা পেনশন পান। ফলে কর্মক্ষম থাকার সময় থেকে শুরু করে কর্মহীন অবস্থায়ও সরকারি কর্মচারীদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা রয়েছে; কিন্তু সাংবাদিকদের নেই। যে যত বড় প্রতিষ্ঠানেই কাজ করুন, যত মেধাবী হোন না কেন, কখন কী কারণে চাকরি যাবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। আবার চাকরি করলেও কবে, কখন, কোনো তারিখে কোন মাসের বেতন পাবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা থাকে না।
তবুও সাংবাদিকদের কলম চলে, ক্যামেরা কথা বলে। সমাজের নানা অনিয়ম-অনাচারের চিত্র তুলে ধরার কারণে অনেকের অকালে জীবনও যায়। তারপরও সাংবাদিকরা কাজ করেন, করে যাচ্ছেন নানা সংকটের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও সাংবাদিকরা ঘরে বসে থাকেন না। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সঠিক তথ্যের সন্ধানে বেরিয়ে যান। খবর সংগ্রহ করে দেশ ও জাতিকে জানান। তাই সাংবাদিকরা ব্যক্তিমালিকাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও তাদের কাজ মূলত রাষ্ট্রের জন্য। সে কারণেই সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ বলা হয়ে থাকে।
করোনা মহামারী সাংবাদিকদের নতুন কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। এ মহামারী থেকে জীবন রক্ষার জন্য বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। এর মধ্যে রয়েছে কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন, সোশ্যাল ডিসটেন্স মেনটেইন, মাস্ক ব্যবহার, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, গরম পানি পান করাসহ আরও কিছু নিয়মকানুন।
অপরদিকে এ নিয়মগুলো যথাযথভাবে মেনে চললে সাংবাদিকতা কঠিন হয়ে যায়। এ অবস্থায় বলা যায়, করোনা মহামারীর সময়ে একজন সাংবাদিক যদি নিজের জীবন বাঁচানোর বিষয়কে প্রাধান্য দেন, তবে তার পক্ষে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়ে। আবার যদি দায়িত্ব পালনকে মুখ্য বিবেচনা করা হয়, তবে সাংবাদিকের জীবন হয় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। মহামারীর সময়ে অন্য কোনো পেশাজীবীর ক্ষেত্রে এ অবস্থা দেখা যায়নি। ফলে করোনা মহামারীর সময়ে সংবাদকর্মীদের পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার ক্ষেত্রে নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। কম-বেশি সব পর্যায়ের সংবাদকর্মীরা উপলব্ধি করেছেন, এ পেশার মানুষ কতটা অসহায়, নিরাপত্তাহীন।
অসংখ্য সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে অসহায় অবস্থার মাঝে পড়েছে। জীবন গেছে অনেকের। সংবাদকর্মীদের রুটি-রুজির নিশ্চয়তাসহ অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে আইনি প্রতিনিধি হচ্ছে সাংবাদিক ইউনিয়ন। সাংবাদিক ইউনিয়ন এ আইনি অধিকার পেয়েছিল ১৯৭৪ সালে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জীবন-জীবিকার খবরাখবর রাখতেন। তিনি জানতেন সাংবাদিকতা পেশার ঝুঁকির বিষয়গুলো। তাই তিনি ১৯৭৪ সালে ‘The Newspaper Employees (Services & Condition) Act 74’ প্রণয়ন করে সাংবাদিকদের অধিকার ও মর্যাদাকে রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সুরক্ষিত করেন। ওই আইনের আলোকেই গঠন করা হয় ওয়েজবোর্ড। ঘোষণা করা হয় রোয়েদাদ।
সাংবাদিক ইউনিয়নের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রতি পাঁচ বছর পরপর সংবাদপত্র শিল্পের সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য ওয়েজবোর্ড গঠন করে।
ওয়েজবোর্ড শুধু একটি বেতন কাঠামো নয়, এটি রাষ্ট্রের আইন। এ আইনে সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতার অধিকারসহ মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান বর্তমানে এ ওয়েজবোর্ড মানছে না।
তারা অন্যান্য শিল্প ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মতো মর্জিমাফিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান চালাতে আগ্রহী। ফলে সাংবাদিকতা পেশায় ক্রমান্বয়ে নানারকমের অনাচার, অবিচার ও দুর্বৃত্তায়নের সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি শত ফুল ফুটতে দেয়ার যুক্তিতে দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের হাতে তুলে দেয়া হয় সংবাদপত্রের মালিকানা। এমন সব লোক রাতারাতি হয়ে যায় গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক-প্রকাশক হয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে অপসাংবাদিকতা। মূলধারার সাংবাদিকদের তুলনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদের দাপট এখন অনেক বেশি।
বর্তমানে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম শিল্পে বহু পক্ষের আবির্ভাব ঘটেছে। মালিক, সম্পাদক, প্রকাশকদের অনেক দল, অনেক গ্রুপ। এসব দল আর গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। কারণ, আন্ডারগ্রাউন্ড শ্রেণির সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম বর্তমানে একটি লাভজনক ব্যবসায়িক খাত। তাই সারা দেশে হাজার হাজার পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন। তার সঙ্গে এখন যোগ হচ্ছে, অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর আইপি টিভি। কিন্তু কেউই সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন দেয় না। ওয়েজবোর্ড মানে না। ক্ষেত্রবিশেষে সাংবাদিকদের কাছ থেকে নানারকমের সুবিধা আদায় করে নেয়। সাংবাদিকদের পরিচয়পত্র এখন নগদ টাকায় বেচা-বিক্রি হয়।
অপরদিকে করোনা মহামারীর এই দুঃসময়ের মধ্যেও দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ সংবাদপত্রে গণছাঁটাই, বেতন না দেয়া, কমিয়ে দেয়া ইত্যাদি নানা নিপীড়ন শুরু হয়। অনেক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই ছাঁটাই প্রক্রিয়া এখনও চলছে।
কতিপয় গণমাধ্যম মালিক, সম্পাদক, প্রকাশকসহ একশ্রেণির সাংবাদিক ‘গণমাধ্যমকে’ কেবল নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করায় রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে সাংবাদিকতা উজ্জ্বলতর ভাবমূর্তি নিয়ে দাঁড়ানোর চেয়ে ক্রমেই কালিমালিপ্ত হয়ে অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্সসহ উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতার উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও অনেকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বর্তমান সময়ের মেধাবী কোনো ছেলেমেয়ে সাংবাদিকতা পেশায় আসবে না। কারণ, তারা দেখছে এ পেশায় জীবন ও জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে। এমতাবস্থায় পেশার মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে পেশাগত সুরক্ষা ও মর্যাদার বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
তাতে একদিকে যেমন পেশাদারিত্ব বাড়বে, তেমনি সমাজ-রাষ্ট্রে সাংবাদিকতার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তা না হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ওয়েজবোর্ড না থাকলে গণমাধ্যমের সম্পাদক থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারী সবাই ‘মজুরে’ পরিণত হবেন। দিনমজুর কাজ করেন কাস্তে, কোদাল, হাতুড়ি-শাবল দিয়ে, গণমাধ্যমকর্মীরা কাজ করেন ‘কলম’ আর ক্যামেরা দিয়ে। দিন শেষে দিনমজুরের ‘মজুরি’ আছে, কিন্তু সেই অর্থে মর্যাদা নেই। তেমনি সাংবাদিকরা ‘মজুরি’ পেলেও মর্যাদা হারাবেন। সাংবাদিকের মর্যাদা না থাকলে এ পেশার অস্তিত্বই থাকে না। শুধু সাংবাদিক ও সম্পাদক নন, প্রকাশকরাও গুরুত্বহীন হবেন।
বর্তমানে বেশীরভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা ব্যাংক একাউন্টে বেতন দিয়ে চেক রেখে দেন। পরবর্তীতে সেই টাকা তুলে নেন। ওয়েজ বোর্ডের শর্ত পূরণের জন্য এই অভিনব পদ্ধতি!
সাংবাদিকদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া
সাংবাদিকরা আজ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে অনেকে সাংবাদিকদের সাংঘাতিক বলছেন। সংবাদ প্রকাশের জন্য অর্থনৈতিক লেন-দেনের অভিযোগ রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে। পত্রিকা অফিসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কেননা, বেতন ছাড়াই চাঁদাবাজীর জন্য সাংবাদিক পুষছেন অনেক পত্রিকা!
ফলে মানুষের আস্থার তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে সাংবাদিকরা। এছাড়াও, কিছু পত্রিকা টাকার বিনিময়ে অশিক্ষিত, মাদক ব্যবসায়ী, বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের সাংবাদিকতার কার্ড প্রদান করছে। যাতে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা প্রশ্নের সন্মুখিন হচ্ছে।
সাংবাদিকদের নামে চাঁদাবাজীর মামলা অনেক সাংবাদিক হয়তো সত্যি চাঁদাবাজীতে যুক্ত। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হচ্ছে। সেই সাথে মিথ্যা চাঁদাবাজীর মামলার সংখ্যাও কম নয়। অনেক সময় কার বিরুদ্ধে সংবাদ করার প্রস্তুতিকালীন সময়ে বা সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে চাঁদাবাজীর মামলা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।
পরিত্রানের উপায়
সাংবাদিকতা পেশা হিসেবেই বাংলাদেশে ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। এখনই সবাই ঐক্যবদ্ধ না হলে, এই পেশা গ্রহণে চরম অনীহার সৃষ্টি হতে পারে।
সাংবাদিকদের জনগনের আস্থা ফিরিয়ে আনাও সময়ের দাবী। তাই দূর্বিত্বদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের ভেদাভেদ ভুলে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে সাংবাদিকদের লাঠিয়াল করছে যারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণও সময়ের দাবী। যে কোন সাংবাদিকদের উপর হামলা, মামলা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সকল সাংবাদিক সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা আবশ্যক। সূত্র : নতুন বার্তা।