বৃহস্পতিবার ● ১ এপ্রিল ২০২১
প্রথম পাতা » জাতীয় » দমনমূলক পরিবেশই গুজবের বসন্ত
দমনমূলক পরিবেশই গুজবের বসন্ত
বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্র সব বিরোধীকে আনায় আনায় ষোলো আনা পরাস্ত করতে পারলেও একজন এখনো অজেয় রয়ে গেছে। মহাকাব্যের বীরের মতো নয়, করোনাভাইরাসের মতো তার ক্ষমতা। নিজেকে অদৃশ্য রেখে, সময়ে সময়ে রং বদলিয়ে, যেকোনো সময়ে যে কেউকে সে আক্রমণ করে বসতে পারে। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন রয়েছে, রয়েছে তাকে আটকানোর সাইবার ও রক্তমাংসের বাহিনী। তবু সে দুর্ধর্ষ। দুর্ধর্ষ অর্থ যাকে দমন বা ধ্বংস করা যায় না। বলা যায়, সরকারের অনেক আচরণ থেকেই সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তার নাম হলো গুজব। সময়টা ফেক নিউজ তথা মিথ্যা সংবাদের যেমন, গুজবেরও তেমন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে যে রক্তপাত, হরতাল, মৃত্যু ইত্যাদি হয়েছে, তার অন্যতম অনুঘটক ছিল গুজব। গুজব আপনা থেকেই বাড়ে না, যখন গণমাধ্যম সত্য প্রকাশ করতে পারে না, যখন দেশের স্বাভাবিক নেটওয়ার্ক দিয়ে ফেসবুকে প্রবেশ করা যায় না, যখন সরকারি প্রেসনোটের বয়ান থাকে অসংখ্য ছিদ্রে ভরা, তখন সেই ছিদ্রগুলো ভরাট করে গুজব, তখন গণমাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ যার যার মনমাফিক সত্যে বিশ্বাস করা শুরু করে। তখনই একজন আরেকজনের কানে, স্বকণ্ঠে বা ইলেকট্রনিক উপায়ে বার্তা দিতে থাকে। সেসব বার্তার মধ্যে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা, তা যাচাই করাও দুষ্কর।
কারণ, গণমাধ্যম পুরো কথা বলছে না, সবার কথা জানাতে পারছে না। এ রকম সময়েই গুজব হয়ে ওঠে জনগণের মিডিয়া। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই গুজবের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের কথা বলুন, গুজবের তাতে কিছু এসে যায় না। সে নিজের নিয়মে কান থেকে কানে, জন থেকে জনে পৌঁছে যেতে থাকে।
ফেসবুক বন্ধ করে যদি বিক্ষোভ দমন করা যেত, তাহলে ইন্টারনেট বন্ধ থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমারে গত প্রায় এক মাসে লাখো মানুষের লাগাতার বিক্ষোভ চলতে পারত না। জীবন দিত না ৫০০-এর বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষ। আর আজকের যুগে ভিপিএনসহ এমন অনেক প্রযুক্তি ও অ্যাপ আছে, যা দিয়ে ‘অনলাইন কারফিউ’ ভাঙা যায়।
ভয় আর মতপ্রকাশের প্রচণ্ড অসুবিধার মধ্যে কোনটা সত্য আর কোনটা গুজব, তা বুঝব কী করে? সরকার যাকে গুজব বলছে, বিশ্বের বাঘা বাঘা অনেক গণমাধ্যম সেসবকে বাংলাদেশের খবর হিসেবে প্রচার করছে। গুজবে বিশৃঙ্খলা বাড়ে তা ঠিক। কিন্তু মতপ্রকাশে বাধা দিলে গুজবের কাটতি বাড়লে কি শৃঙ্খলা ফিরে আসে?
দমনমূলক পরিবেশই গুজবের বসন্ত। সময়ের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলোয় হাত দিলে যদি হাত পোড়ে, তাহলে খিড়কি দরজা দিয়ে গুজব পাড়া বেড়াতে বেরোবে। সরকারি প্রেসনোটের মাঝে ফোকর ধরা পড়লে জানবেন, সত্যটা ওই পথেই পগার পার। এমন দিনেই তারে বলা যায়…‘শুনছেন, কী হইছে?’
গুজব অনেক সময় খবরের ভগ্নাংশ। পুরো খবরটা প্রচারিত হলে গুজব আর কাজ করতে পারে না। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নাজুক হলে যেমন ভাইরাস কাবু করে ফেলে, সংবাদমাধ্যম সাংবাদিকতার ইমিউনিটি হারিয়ে ফেললেও তেমনি গুজবের বাজার বসে।
গুজবের সমস্যা হলো, তা উত্তর দেয় না, গুজবের লাইসেন্স কেবল প্রশ্ন করার। গুজব অনেক সময় ঘটনা সম্পর্কে সঠিক কৌতূহলটাই প্রকাশ করে। কিন্তু গুজবে ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিলে ভুল হবেই। গুজবের তালি তাই এক হাতে বাজে না। সরকার যদি কথা ও কাজে স্বচ্ছ থাকে, জনগণের কাছে সত্যটা প্রকাশ করে, তাহলে গুজবের ডানা গজাতই না। একটি সঠিক খবরই কিন্তু গুজবের ডানা কাটার জন্য যথেষ্ট। গুজব খণ্ডনের দায়িত্ব কিন্তু সরকারের, মিডিয়ার। যখন তারা জনগণের সত্য জানার তৃষ্ণা মেটাতে পারে না, তখন গুজবই তাদের কান ধরে টানে।
সবচেয়ে বড় কথা, সরকার কিংবা গণমাধ্যম আস্থা হারালে গুজব ডালপালা ছড়াবেই। গুজব আগে কানে কানে বলা হতো, এখন বলা হয় ফেসবুকে। গুজবে গজব নেমে আসতে পারে, যেমন দেখা গিয়েছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার সময়। আবার গুজব গর্জন হয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পারে। শাহবাগ গণজাগরণ উসকে দিয়েছিল একটি গুজব, যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় নিয়ে সরকার আপস করেছে। গত ২৬ মার্চও পুলিশের গুলিতে অনেকের হতাহতের গুজব পরের দুই দিনের বিক্ষোভকে আরও জ্বলন্ত ও চাঙা করেছে। ফলে মারা গেছে মাদ্রাসার অনেক ছাত্র।
উদ্বিগ্ন জাতি গুজবে কান পাতবেই। গুজব দমনমূলক পরিস্থিতির বাইপ্রোডাক্ট। তা জানায়, দেশে জবাবদিহি নেই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। গুজবে কান পাতে তারাই, যারা জানতে পারে না ‘আসলে’ কী ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গুজব জনগণের মিডিয়া হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর নাস্তানাবুদ হওয়ার মেলা গুজব মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙা করেছিল আর গুজবের আক্রমণে পেরেশান হয়েছিল হানাদারেরা।
উত্তরহীনতার পরিবেশে গুজবের পাল্লাই ভারী হয়। তখন তা এমন সব ‘সত্য’ পয়দা করে, যা আর প্রমাণের ধার ধারে না। সত্য তখন জানার বিষয় থাকে না আর, বেছে নেওয়ার বিষয় হয়। গুজবের বাজারে এখন অনেক সত্য। নিজ নিজ রাজনৈতিক পক্ষ অনুসারে মানুষ পছন্দের সত্য বেছে নিচ্ছে। গুজবের সহজ সমাধান হলো, মানুষের জানার অধিকারকে শ্রদ্ধা করা।
ক্ষমতাবানেরাও গুজবের ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাস করে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় কঠোরতা দেখান। তখন তার শিকার হয় নিরীহরা। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন পক্ষও গুজব ছড়াচ্ছে। বানোয়াট কিংবা অতীতের ছবি তুলে এনে প্রতিপক্ষকে ‘হিংস্র’ হিসেবে চিত্রিত করার সুযোগ নিচ্ছেন। এই কৌশল অতীতে কাজ করলেও বর্তমানে তার ধার ভোঁতা হয়ে এসেছে। মানুষ কাউকেই তেমন বিশ্বাস করছে না। এমন পরিস্থিতি অন্ধকার ঘরে দুই পক্ষের লড়াইয়ের মতো। গুজবের অন্ধকারে করা আঘাত অনেক সময় আত্মঘাতী হয়, তা তখন আপন-পর চিনতে পারে না।
মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পটা আমরা জানি। বারবার মিথ্যা হুঁশিয়ারি দিয়ে নিজেকে অবিশ্বস্ত করে তুলেছিল সে। যখন সত্যিই বাঘ এল, কেউ সাড়া দিল না। বাঘ তাকে খেয়ে ফেলল। মিথ্যা তার রচয়িতাকেও ছাড়ে না।
এবার গল্পটা বাঘের দিক থেকে পাঠ করা যাক: বাঘ দেখল রাখাল শুধু মিথ্যাই বলে যায়। যে নিরন্তর মিথ্যা বলে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা কম, তাকে বাঘের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। বাঘের পাল তখন নির্ভয়ে জনপদে হামলে পড়ল। গুজব ও মিথ্যা শেষ পর্যন্ত তাদের প্রচারকদেরই খায়। মিথ্যাবাদী রাখালেরা আসলে বাঘেরই সাহায্যকারী, কিন্তু শেষতক তারও প্রাণ যায়।
মিথ্যার সুবিধা কেবল বাঘই, অর্থাৎ ক্ষমতাবানেরাই পায়, রাখাল ও তার গরুরা কেবল শিকারই হয়। সূত্র : প্রথম আলো
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]