বুধবার ● ২১ এপ্রিল ২০২১
প্রথম পাতা » জাতীয় » করোনাকালিন নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে
করোনাকালিন নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে
করোনা মহামারির অর্থনৈতিক ধাক্কার কারণে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।
নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে একবছরে মোট জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হয়েছে।
মহামারির কারণে অনেকের আয় কমে গেছে এবং জনসংখ্যার বড় একটি অংশ শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে উঠে এসেছে জরিপের ফলাফলে।
বেকার হয়ে যাওয়ার কারণে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়া, সঞ্চয় কমে যাওয়া ও ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তাদের সার্বিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
দ্য পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) গতকাল মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তাদের জরিপের ফলাফল জানিয়েছে।
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল নতুন দরিদ্রতা সাময়িক। কিন্তু মহামারির এক বছর পরেও যারা দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছিলেন তারা বের হয়ে আসতে পারেননি।’
জনগণের আয় ও দরিদ্রতার ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কিত পিপিআরসি এবং বিআইজিডি-এর তৃতীয় গবেষণা এটি। প্রতিষ্ঠান দুটি এই র্যাপিড রেসপন্স গবেষণার জন্য প্যানেল জরিপের ভিত্তিতে গ্রাম ও শহরের ছয় হাজার বস্তিবাসীর ওপর জরিপ চালিয়েছে।
গত বছরের এপ্রিল মাসে একই সংখ্যক বস্তিবাসীর ওপর পরিচালিত প্রথম র্যাপিড রেসপোন্স গবেষণায় দেখা যায় মহামারির প্রথম ঢেউয়ে তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ, অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছিলেন। আগে যে ২০ দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিলেন তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন এই ২২ শতাংশ মানুষ।
পিপিআরসি এবং বিআইজিডি জানিয়েছে, গত এক বছরে নতুন দরিদ্রের কিছু অংশ দরিদ্রতা থেকে বের হতে পেরেছে। বর্তমানে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র।
হোসেন জিল্লুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধার ও মহামারি মোকাবিলার সামর্থ্য মানুষ হারিয়েছে। আয় কমে গেলেও তাদের ঋণ বেড়েছে।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাবেক উপদেষ্টা জিল্লুর রহমান জানান, সর্বশেষ গবেষণার ফলাফল ধারনা দেয় যে, জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম করছে।
তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় গত বছর যে অর্থনৈতিক ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছিলাম তা কাটিয়ে উঠতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে যদি একই ধরনের অর্থনৈতিক ধাক্কার সম্মুখীন হই তাহলে চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা আরও প্রকট হবে।’
একটি স্মার্ট লকডাউন এই পরিস্থিতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু তার আগে মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে বলে যোগ করেন তিনি।
জরিপে দেখা গেছে, চরম দারিদ্র্যের হার ফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চ মাসে চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
শহরের দরিদ্র মানুষের ওপর মহামারির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে। তাদের দৈনিক আয় ১২৪ টাকা থেকে ১০৭ টাকায় নেমে এসেছে।
কিন্তু গ্রামীণ মানুষের আয় ১০৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০৮ টাকা হয়েছে।
কৃষিখাতের সাফল্যে গ্রামীণ অর্থনীতির অর্থনৈতিক দুরবস্থা শক্তভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, মহামারি শুরুর পর ২৭ দশমিক তিন শতাংশ বস্তিবাসী শহর ছেড়ে গ্রামে গেছেন। যাদের নয় দশমিক আট শতাংশ এখনো ফেরেননি।
এমনকি শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া এখনো থামেনি। গত বছরের জুন পর্যন্ত ছয় দশমিক আট শতাংশ মানুষ শহর ছেড়েছেন।
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন জানান, মানুষের মাথার ওপর ঋণের বড় বোঝা, সঞ্চয় অনেক কমে গেছে।
এই বছরের মার্চে শহরের বস্তিবাসীদের ঘরপ্রতি সঞ্চয় ১৬ হাজার ৭০৭ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ শতাংশ কমেছে বলে জানান তিনি।
এ বছরের মার্চে শহরবাসীর ঋণের পরিমাণ ৪২ হাজার ৯৬১ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ৮৬ শতাংশ বেড়েছে।
একই পরিস্থিতি গ্রামাঞ্চলেও। তাদের ঋণ ৫৮ হাজার ১০১ টাকা। যা গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ৭৫ শতাংশ বেশি।
চাকরির বাজরেও মন্দাবস্থা দেখা দিয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে চাকরি ছিল এমন আট শতাংশ মানুষ এ বছরের মার্চ পর্যন্ত কোনো চাকরি পাননি। তারা অনিশ্চিত পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন বলে জানান ইমরান মতিন।
দক্ষ কর্মী ও যারা ভালো বেতনের চাকরি করতেন তারাই চাকরি নিয়ে বেশি সমস্যায় আছেন। গৃহপরিচারিকারাও একই ধরনের সমস্যায় রয়েছেন বলে জরিপের ফলাফলে জানানো হয়। জরিপ মতে, বেকাররা তাদের খাবারের ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন।
জরিপে দেখা গেছে, করোনার আগে প্রতিদিনের জন্য শহরের মানুষের খাবারের খরচ ছিল ৬৬ টাকা। বর্তমানে এটি আগের চেয়ে ১৭ শতাংশ কমেছে। তবে গ্রামীণ মানুষের খাবারের খরচ এক টাকা বেড়ে ৫৩ টাকা হয়েছে।
এই বিরূপ পরিস্থিতিতে, খাদ্যের অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলাফল হিসেবে দেখা গেছে, শহরের দুই দশমিক তিন শতাংশ মানুষ সারাদিন না খেয়ে থাকেন। যেখানে গ্রামে এই হার এক শতাংশ বলে জানান ইমরান মতিন।
তিনি বলেন, ‘নারীরা সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছেন। গত এক বছরে ৩১ শতাংশ নারী চাকরি হারিয়েছেন।’
নারীদের কর্মহীনতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে এমনিতেই শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ কম।
হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, মহামারির প্রথম ঢেউয়ে ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। অধিক সংখ্যক মানুষ তাদের আগের কাজে ফিরে যেতে না পারায় তাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবহন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার একটি ইঙ্গিত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা অর্থনীতির আরেকটি সংকট। মহামারির এই সংকটে মানুষকে সমস্যা সমাধানে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনা মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ প্রতীকী ভূমিকা রেখেছে মাত্র। মানুষের আয়ের সক্ষমতা কমে যাওয়ায় অরক্ষিত মানুষের ওপর এর প্রভাব ব্যাপক আকার ধারণ করবে।
তিনি আরও বলেন, মানুষের সক্ষমতার এমন অবস্থার মধ্যেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করতে হবে।
সরকারের অনুদান দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে মোবাইল ফাইনেন্সিয়াল সেবা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় কৃষিখাত ভালো ভূমিকা পালন করেছে। কৃষিখাতে বেশি মনোনিবেশ করে নতুন নীতির মাধ্যমে এই খাতকে আরও শক্তিশালী করাই হবে করোনা পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিক্ষা। করোনা মহামারির আগের অবস্থা থেকে গ্রামীণ মানুষের আয় এক দশমিক নয় শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রথম ঢেউয়ের পর অনেকেই দক্ষতা নেই এমন কাজে যোগ দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারকে কুটির, ক্ষুদ্র ও এসএমই খাত পুনরুদ্ধারের জন্য জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।
জিল্লুর হোসেন আরও বলেন, ‘বৃহৎখাতগুলো সরকারের প্রণোদনার সুবিধা পেলেও মাঝারিখাত বা মধ্যম আয়ের মানুষগুলো তেমনভাবে প্রণোদনার সুবিধা পায়নি।’ সূত্র : দ্য ডেইলী ষ্টার