শুক্রবার ● ২ অক্টোবর ২০১৫
প্রথম পাতা » অপরাধ » কাশিমপুর কারাগারে লাল সালুতে মোড়ানো সাকার মৃত্যুপরোয়ানা
কাশিমপুর কারাগারে লাল সালুতে মোড়ানো সাকার মৃত্যুপরোয়ানা
মুহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক, গাজীপুর প্রতিনিধি :: মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে আপিল বিভাগ। গত বুধবার এই রায় প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়েছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুর্নবিবেচনার আবেদন করতে পারবেন।
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেছিলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে চলতি বছরের ২৯ জুলাই আপিল বিভাগ তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখে।
২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ১৬ জুল আপিল বিভাগ তারও মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে।
রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
লাল সালুতে মোড়ানো বিএনপির নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা) মৃত্যু পরোয়ানা গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ -এ পৌঁছেছে ৷
১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাত ৮ টা ৫৫ মিনিটে ওই পরোয়ানা কারাগারের সুপারের কাছে পৌঁছে ৷ এরপর আনুষ্ঠানিকতা শেষে কারাগারের সুপার রাত ৯টা ১০ মিনিটের দিকে ৬৬ বছর বয়সী সাকা চৌধুরীকে তার মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনান ৷ এসময় সাকা চৌধুরী রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবেন বলে কারাগারের সুপারকে জানিয়েছেন ৷
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এর সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা আমাদের সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর এর গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি মুহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিককে জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই পরোয়ানা পাঠানো হয় ৷ রাত ৮টা ৫৫ মিনিটের দিকে তা কাশিমপুর কারাগারে আসে৷ লাল সালুতে জাজমেন্টের কপির সাথে এক্সিকিউশন অর্ডারও রয়েছে ৷ একটি গাড়িতে করে পরোয়ানার সাথে কারা কর্মকর্তা ও পুলিশসহ ৭জন ছিলেন ৷ ২০১২সালের ২৩ ডিসেম্বর থেকে সালাহ উদ্দীন কাদের চৌধুরী এ কারাগারেই আছেন ৷
কারাগার সূত্র আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি মুহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিককে জানায়, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর রায় এসেছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ৷ প্রসিকিউশনের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে তিনি ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হন ৷ এর মধ্যে চার অভিযোগে তার মৃত্যুদন্ড এবং পাঁচ অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড হয় ৷
সর্বোচ্চ আদালত তার আপিল আংশিক মঞ্জুর করে আটটিতে দন্ডাদেশ বহাল রাখে, একটিতে সাকা চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয় ৷ ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে চট্টগ্রামের রাউজানে কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের ঘটনায় তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল রাখা হয় ৷ ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০ বছরের কারাদন্ড বহাল থাকলেও ৭ নম্বর অভিযোগে ২০ বছরের সাজার ক্ষেত্রে আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ ৷ ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচ বছর কারাদন্ডের রায় বহাল রাখা হয় চূড়ান্ত রায়ে ৷
জীবনভর বিভিন্ন কর্মকান্ড ও দাম্ভিক মন্তব্যের কারণে বিতর্কিত সাকা চৌধুরীই প্রথম বিএনপি নেতা, যাকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে ৷ ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর ট্রাইব্যুনালে দন্ডিতদের মধ্যে সাকা চৌধুরী হলেন পঞ্চম ব্যক্তি এবং বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা দ্বিতীয় ব্যক্তি, আপিল বিভাগে যার মামলার নিষ্পত্তি হল ৷
রায় বাস্তবায়নের পদ্ধতিঃ সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর নিয়ম অনুযায়ী তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে৷ সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল৷ সেই মৃত্যু পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ ৷ পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামি পক্ষ ৷ আসামী পক্ষের রায়ের কপি পাওয়া অথবা আসামীকে রায় শোনানোর মধ্যে যেটি আগে হবে তখন থেকেই শুরু হবে দিন গণণা ৷ তবে রিভিউ যে আপিলের সমকক্ষ হবে না, তা যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়েই স্পষ্ট করা হয়েছে ৷ রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদন্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে ৷ তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন৷ রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে ৷
গ্রেফতারঃ হরতালে গাড়ি পোড়ানোর একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর সালাউদ্দিন কাদেরকে গ্রেফতার করা হয়৷ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয় ১৯ ডিসেম্বর৷ ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল ৷
জন্ম ও পরিচয়ঃ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে৷ ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীর চার ছেলের মধ্যে সাকা চৌধুরীই সবার বড়৷ তার সেজ ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ৷ তিনিও একসময় সাংসদ ছিলেন ৷ বাকি দুই ভাইয়ের মধ্যে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী মারা গেছেন ৷ আর জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী ৷
রাজনীতিঃ বাবা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এক সময় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকারও হয়েছিলেন৷ সালাউদ্দিন কাদেরের রাজনীতির শুরুও মুসলিম লীগ থেকেই ৷ পরে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে তিনি বিএনপিতে আসেন৷ গত দুই দশকে চটকদার,’ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ এবং কখনো কখনো ‘অশালীন’ মন্তব্যের কারণে বার বার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছেন সালাউদ্দিন কাদে র৷
একাত্তরের অপরাধের জন্য বিতর্কিত এই রাজনীতিবিদ ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে রাউজানের সাংসদ নির্বাচিত হন ৷ সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং কার্যত এর মধ্যে দিয়েই মূল ধারার রাজনীতিতে তার পুনর্বাসন ঘটে ৷
১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির টিকেটে নির্বাচন করে নিজের এলাকা রাউজান থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন সাকা ৷ কিন্তু পরে দল থেকে বহিষ্কৃত হন৷ এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে তিনি নির্বাচন করেন নিজের গঠন করা দল এনডিপি থেকে ৷ আবারও তিনি রাউজানের এমপি হন ৷ এর কিছুদিন পর এনডিপি বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয় এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির টিকেটে সাংসদ নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন ৷ পরের নির্বাচনে ২০০১ সালে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে৷ বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বও তিনি পালন করেন ৷ এর আগে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ওগণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন সাকা চৌধুরী ৷ সর্বশেষ ২০০৮ সালের র্নিবাচনে রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি থেকে অংশ নেন সাকা ৷ তিনি রাঙ্গুনিয়াতে হেরে গেলেও ফটিকছড়ি, অর্থাত্ চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন ৷ তিনি সাংসদ থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় আসে ৷
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এর সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা জানান, রায়ের কপি কারাগারে এসে পৌঁছেছে ৷ আনুষ্ঠানিকতা শেষে কিছুক্ষণের মধ্যে জেল কোড ও আইসিটি অ্যাক্ট অনুয়ায়ী তাকে এ রায় পড়ে শোনানো হবে ৷আপলোড : ২ অক্টেবর ২০১৫ : বাংলাদেশ : সময় : রাত ৮.৪০মিঃ