শনিবার ● ১২ মার্চ ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পরিচয় দানকারী বিভাস দেওয়ানসহ ১২ জন আটক
সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পরিচয় দানকারী বিভাস দেওয়ানসহ ১২ জন আটক
অনলাইন ডেস্ক :: সেনাবাহিনীর অফিসার পরিচয় দিয়ে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে গিয়ে প্রতারনা করার সময় কথিত লেপ্টেনেন্ট বিভাষ দেওয়ানসহ ১২ জন পাহাড়িকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি’র বরকল জোন। আটতককৃতদের মধ্যে তিনজন বৌদ্ধ ভান্তেও রয়েছে বলেও জানাগেছে। বরকল বিজিবি জোনের দায়িত্বশীল সূত্র ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছেন ঘটনাটি বৃহস্পতিবার দুপুরের।আটককৃতদের মধ্যে সেকেন্ড লেপ্টেনেন্ট পরিচয়দানকারী পাহাড়ি যুবকের নাম বিভাস দেওয়ান, তার পিতার নাম-বি কে দেওয়ান, মাতার নাম কনিকা দেওয়ান, সাং- বিজয় সরনী, থানা কোতয়ালী, আটককৃত অপর ১১ জন হলো- (২) রিটেন চাকমা (২২)পিতা-নিহারবিন্দু চাকমা, মাতা উষাদেবী চাকমা, গ্রাম- বজ্রমোহন পাড়া, থানা পানছড়ি জেলা খাগড়াছড়ি, (৩) সুনীতি বিকাশ চাকমা (২১) পিতা-জগৎ চন্দ্র চাকমা, মাতা-মৃত কালা চৌগি, গ্রাম-তংতুলা, থানা কোতয়ালী-রাঙামাটি, (৪) রিপেন চাকমা (২৫) পিতা-নয়ন বিকাশ চাকমা,গ্রাম- উত্তর সারোয়াতলী, থানা-বাঘাইছড়ি, (৫) রিগেন চাকমা (১৮) পিতা-সুরেনময় চাকমা, গ্রাম- নোয়াদম,থানা-নানিয়ারচর, (৬) ছন্দ সেন চাকমা (৩৫) পিতা-প্রতাপ চন্দ্র চাকমা, গ্রাম-রাজদ্বীপ বাবু পাড়া, কোতয়ালী থানা রাঙামাটি, (৭) মুক্তবীর চাকমা(২২) পিতা-প্রদীপ কুমার চাকমা, গ্রাম-ছোট কাট্টলী, থানা-লংগদু, (৮) রুহিত চাকমা (২১), পিতা- নিহার বিন্দু চাকমা, গ্রামÑবনরূপা, কোতয়ালী থানা-রাঙামাটি, (৯) জ্যাকশন চাকমা (২০), পিতা- দেব রঞ্জন, গ্রাম-কলেজ গেইট রাজমনি পাড়া, থানা-কোতয়ালী রাঙামাটি পার্বত্য জেলা, (১০) শ্রীমৎ বুদ্ধজ্যাতি ভান্তে (২০), সাং-রাঙামাটি রাজবন বিহার, (১১) গিরিমান্দ ভান্তে (৩৫) সাং-রাঙামাটি রাজবন বিহার ও অপরজন হলো শান্তপ্রিয় ভান্তে (৩৮), সাং-রাঙামাটি রাজবন বিহার।
আটককৃতদের মধ্যে রাঙামাটি সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত রয়েছে ৫ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছে একজন, চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছে একজন। বাকিদের মধ্যে বৌদ্ধ ভান্তে রয়েছেন তিনজন, বাকি একজন ফটো সাংবাদিক।
আটকৃতদের কাছ থেকে সেনা অফিসারের পোশাক-দামি ক্যামেরাসহ গুরুত্বপূর্ন কাগজপত্র পাওয়া গেছে। উক্ত ঘটনায় আটককৃতদেরকে বিজিবি ক্যাম্পে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদেরকে বরকল থানায় সোপর্দ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বরকল বিজিবি জোনের দায়িত্বশীল সূত্র।
শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে তাদের হস্তান্তর করা হয় বলে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে নিশ্চিত করেছের বরকল থানার অফিসার ইনচার্জ নীলু কান্তি বড়ুযা। আটককৃতদের বিরুদ্ধে বরকল জোনের নায়েক মো. জাকির হোসেন বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।
বিজিবি বরকল জোনের অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মো. আলাউদ্দিন আল মামুন স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে তাদের আটক করা হয়। এর আগে আটক ১২ জনের দলটি বরকলের শীর্ষ পাহাড় এসএস টিলায় গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তাদের দলের একজন এসএস টিলাস্থ বিজিবি ক্যাম্পে গিয়ে নিজেকে সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পরিচয় দেন। এই পরিচয়ের কারণে বিজিবির সদস্যরা সেখানে তাদের আপ্যায়ন করেন। তবে ভুয়া সেনা কর্মকর্তার কথা বার্তায় সন্দেহ হলে বিষয়টি বরকল বিজিবি জোনে খবর দেন।
বিজিবি’র জোন কমান্ডার তার ক্যাম্প ইনচার্জ এর ফোনে সেনা অফিসার পরিচয় দেওয়া সেই পাহাড়ি যুবকটির সাথে কথা বলেন। এসময় কমান্ডার পাহাড়ি যুবককে প্রশ্ন করে জানালেন, আপনি একজন সেনা অফিসার পরিচয় দিলেন; আপনি জানেন না, এই ধরনের ক্যাম্পে উপস্থিত হতে হলে পূর্বানুমতি নিতে হয়? বিজিবি কর্মকর্তার এই প্রশ্নের জবাবে সরি বলে তড়িগড়ি করে উক্ত ক্যাম্প থেকে নীচে নেমে স্প্রিড বোটে করে চলে যাওয়ার চেষ্ঠা চালায় সেনা কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী পাহাড়ি যুবক ও তার সঙ্গীরা।
পরে পাহাড় থেকে নেমে বরকল সদরের বিজিবি চেকপোস্ট এলাকাটি তারা বিচ্ছিন্নভাবে পার হচ্ছিলেন। এতে বিজিবির আরো সন্দেহ বাড়ে। তাছাড়া যিনি নিজেকে সেনা অফিসার পরিচয় দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট দফতরে খবর নিয়ে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এজন্য তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।
এসময় তাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাদের তথ্যানুযায়ি সিলেট ১৮ বীরের সাথে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে জানায়, বিভাস দেওয়ান নামে তাদের কোনো অফিসার নেই। এরপরই উক্ত বারোজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে বিজিবি। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তাদের সাথে থাকা ব্যাগে তল্লাসী চালিয়ে সেনা অফিসারের পোশাক সদৃশ একসেট ইউনিফর্ম, দামী ক্যামেরাসহ গুরুত্বপূর্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় নিউজ পোর্টাল সিএইচটি টাইমস টোয়েন্টিফাের ডটকম এর অনুসন্ধানে বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, আটককৃতদের কাছ থেকে ২২টি মোবাইল ফোন, ৩টি অত্যাধুনিক ক্যামেরা ছাড়াও নতুন মডেলের সেনা পোশাক-৩ জোড়া, ওয়ার্কিং ড্রেসের জার্সি-১টি, বিএমএ ক্যাডেটদের ব্যবহৃত হ্যান্ড ব্যাগ-১টি, অফিসার এসডি পোশাক-১ পেয়ার, বীর রেজিমেন্টের গ্রীণ ক্যাপ-১টি, র্যাংক ব্যাজ ২ লেঃ বীর-২ পেয়ার, র্যাংক ব্যাজ লেঃ বীর-১ পেয়ার, অফিসার মেসকীট-১ পেয়ার, বিভিন্ন ডিবিশনের ডিভ সাইন-৮টি, কমান্ড ব্যাজ-২টি, বিভাস লেখা নেইম প্লেট-২টি, ডিএমএস বুট-১ জোড়া, পিটি-সু-১ জোড়া, কালো মুজা-১ জোড়া, বেল্ট-১টি, কম্ব্যাট গেঞ্জি-১টি, প্যারা উইং গ্রীণ কালার-১টি, এ্যামোনেশন উইং-১টি, বিভাস লেখা অফিসার পরিচয় পত্র-১টি, ৭৪তম বিএম লং কোর্সের ক্রেষ্ট-১টি, ডেল কোম্পানীর ল্যাপটপ-১টি, এইচপি কোম্পানীর ল্যাপটপ-১টি, রিবন-২টি, মেডেল-২টি, চেতনা ও মূল্যবোধের কার্ড-১টি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী লেখা-৩টি।
এছাড়াও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃত বিভাস দেওয়ান জানান, চট্টগ্রামেও তাদের একটি বাড়ি রয়েছে। পরে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের বাসায়ও অভিযান চালানো হয়েছে বলে জানাগেছে একটি দায়িত্বশীল সূত্রে। সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের নেতৃত্বে পরিচালিত যৌথ বাহিনীর এই অভিযানে ভূয়া সেনা অফিসারের চট্টগ্রামের বাসা থেকে তিন সেট সেনা পোশাক, ল্যাপটপসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তুরের গুরুত্বপূর্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। এসময় বাড়িটিতে অবস্থানকারি চার পাহাড়ি যুবককেও আটক করে যৌথ বাহিনী।
রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাতে আটককৃতদেরকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে যৌথবাহিনী। তিনি জানান, সামরিক স্থাপনায় গিয়ে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা-ছবি তোলা, প্রতারনার আশ্রয় নিয়ে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় প্রদান করায়, রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধনে অর্ন্তঘাত মূলক কাজের অপরাধে আলাদা দুইটি মামলা দায়ের করা হবে।
এদিকে, নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্রে জানাগেছে, বিষয়টিকে অতীব গুরুত্ব দিয়ে টানা দুইদিন সময় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আটককৃতদের মধ্য থেকে বিভাস চাকমাসহ আরো কয়েকজন বিদেশী রাষ্ট্র থাইল্যান্ডের একটি সংস্থার হয়ে গুপ্তচর ভিত্তির সাথে জড়িত।
এরই ধারাবাহিকতায় বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সেনা ক্যাম্পে গিয়ে সেনা বাহিনীর অফিসার পরিচয় দিয়ে ক্যাম্পগুলোর ভৌগলিক অবস্থানের ছবি ও ডাটা সংগ্রহ করা-ই ছিলো আটককৃতদের মূল কাজ। সংগৃহিত এসব ডকুমেন্ট পরবর্তীতে তুলে দেওয়া হতো থাইল্যান্ডের সেই গ্রুপটির হাতে। এছাড়া এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সাথে বাইরের বেশ কয়েকটি দেশের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। এসব কাজ মূলত করতো আইটি বিষয়ে এক্সপাট বিভাস দেওয়ান চাকমা।
একটি সূত্র থেকে জানাগেছে, গত ২৭ শে জানুয়ারী রাঙামাটি সদরস্থ ফুরোমোন বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে সেখান থেকেও পাশ্ববর্তি সেনা ক্যাম্পে গিয়েছিলো এই দলটি। সেখানেও বিভাস দেওয়ান নিজেকে সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ছবি তুলেছিলেন এবং কিছুক্ষণ অবস্থান করেছিলেন। সূত্র :সিএইচটি টাইমস টোয়েন্টিফাের ডটকম।