রবিবার ● ১২ ডিসেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » রাঙামাটিতে গ্রাম্য সালিশে যুবককে মধ্য যুগীয় কায়দায় জুতার মালা পরানোর দৃশ্য পেইজবুকে ভাইরাল হওয়ার ৬দিন পরেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি
রাঙামাটিতে গ্রাম্য সালিশে যুবককে মধ্য যুগীয় কায়দায় জুতার মালা পরানোর দৃশ্য পেইজবুকে ভাইরাল হওয়ার ৬দিন পরেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি
স্টাফ রিপোর্টার :: স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানির কথিত অভিযোগে মানবধিকার লংঘন করে গ্রাম্য সালিশে এক যুবককে মধ্য যুগীয় কায়দায় অমানবিক নির্যাতন করে জুতার মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানোর পর যুবককে গুম করার অভিযোগ করেছেন গুম হওয়া যুবককের মা।
জানাযায়, গত ৭ ডিসেম্বর-২০২১ ইংরেজি তারিখ সোমবার সকাল ১০টার দিকে রাঙামাটি শহরের দেবাশীষ নগর এম.এন লারমা স্মৃতি পাঠাগার (ক্লাব ঘর) এ বৈঠক বসিয়ে স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানির কথিত অভিযোগে ২০-৩০ জন লোক গ্রাম্য সালিশে মৃত যতিন্দ্র লাল বড়ুয়ার ছেলে সুজন বড়ুয়া (৩৫) কে প্রথমে ক্লাব ঘরে ভিতর অমানবিক নির্যাতন, জুতা দিয়ে ইচ্ছামত পিঠিয়ে পরে জুতার মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানোর এক পর্যায়ে সালিশকারীরা সুজন বড়ুয়াকে গত ৬ দিন ধরে কোথায় রেখেছেন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
দেবাশীষ নগর এম.এন লারমা স্মৃতি পাঠাগারে সালিশ চলাকলিন সুজন বড়ুয়াকে জুতা দিয়ে পিঠানো এবং তাকে জুতার মালা পরানোর ১টি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরার পর কথিত অভিযুক্ত সুজন বড়ুয়ার মা মন্টু বালা বড়ুয়া (৭৮) এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, চলিত ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে ৩জন মেয়ে আমার ছেলে (সুজন বড়ুয়া) কাছ থেকে ঘর ভাড়া নেয়।
মন্টু বালা বড়ুয়া বলেন, গত ৬ ডিসেম্বর সোমবার ঐ ভাড়াটিয়া মেয়েদের কাছে ভেদভেদী এলাকা থেকে ১জন চাকমা যুবক বেড়াতে আসে, এর পর রাত ৩টার দিকে ভাড়াটিয়াদের কক্ষে চিৎকার এবং শোরঘোল শুনতে পাই, আমি (মন্টু বালা বড়ুয়া) আমার ঘরের দরজা খুলে দেখি অনেক গুলো চাকমা ছেলে আমার বাড়ির উঠানে দাড়ানো,আমি জিজ্ঞাস করি কি হয়েছে বাবারা ? আমার বাড়িতে প্রবেশ করা ছেলেরা বলে, কিছু হয়নি, আপনি ঘুমাতে যান।
এর পর ৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৯টা-১০টার দিকে ক্লাবের মিলন চন্দ্র চাকমা এবং পাড়ার রবি বড়ুয়া এসে আমার ছেলেকে ডেকে নিয়ে যায়। পাড়ার লোকজনের কাছে শুনেছি, আমার ছোট ছেলে সুজন বড়ুয়াকে ক্লাব ঘরে ইচ্ছামত পিঠিয়ে জুতার মালা পরিয়ে দেবাশীষ নগরের রাস্তায় রাস্তায় হাটিয়েছে এবং হাটাতে হাটাতে আমার ছেলেকে তারা কোথায় নিয়ে গেছে আমি জাানি না।
মন্টু বালা বড়ুয়া বলেন, এর পরের দিন ৮ ডিসেম্বর বুধবার রাঙামাটি কোতয়ালী থানা থেকে পুলিশ আমার বাড়িতে এসে বিস্তারিত সকল ঘটনা লিখে নিয়ে গেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আমার ছেলে এখনো বাড়িতে ফিরে আসেনি, মন্টু বালা বড়ুয়া বলেন, পাড়ার লোকজন বলাবলি করছে, আমার ছেলে সুজনকে না-কি গুম করা হয়েছে।
সুজন বড়ুয়ার মা মন্টু বালা বড়ুয়া বলেন, এক ঘরে ৩টা মেয়ে ও ১ ছেলে ঐ রাত্রি ছিলো, তাহলে কি করে আমার ছেলে সুজন কোন মেয়ের গায়ে হাত দিলো, এটা বানোয়াট ঘটনা বলে সুজন বড়ুয়ার মায়ের দাবি, তিনি আরো বলেন, ক্লাব তো কোন কোর্ট কাচারী নয়, আমার ছেলে অপরাধ করিলে আমাকে বলা উচিত ছিলো, আমি তখন আমার আত্মীয়-স্বজন, স্থানীয়দের এবং সমাজের মুরব্বীদের নিয়ে আমার ছেলে অপরাধ কি জেনে ব্যবস্থা নিতাম। আর না হয় তারা আমার ছেলেকে পুলিশের কাছে দিয়ে দিতেন।
এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সুজন বড়ুয়ার মা মন্টু বালা বড়ুয়া, তিনি তার ছেলেকে ফিরে পেতে স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিকট সহযোগিতা কামনা করেছেন।
শ্লীলতাহানির কথিত ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রদত্ত বক্তব্য হুবহ প্রকাশ করা হল, (কেএস চাকমার টাইম লাইন থেকে) ভিকটিম জানায়, গত ৪ ডিসেম্বর বাসা ভাড়া খোঁজার জন্য ঐ এলাকায় যায়। এবং দেবাশীষ নগরে ৮ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বাড়িওয়ালা সুজন বড়ুয়া সাথে দেখা হয়। আমার বাড়ির রুম খালি আছে এই মর্মে ভিকটিমকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়। সুজন বড়ুয়া ঐ শিক্ষার্থীকে বাসা ভাড়া দেন। এরপর কয়েক দিন থাকার পর ধর্ষনের চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ। ভিকটিমের অভিযোগ গত ৬ ডিসেম্বর-২০২১ সোমবার রাত অনুমানিক ৩টার দিকে বাড়ি ওয়ালা সুজন বড়ুয়া তার কক্ষে ঢুকে যায়। মুখ চেপে ধরে এবং চুপ থাকার জন্য হুমকি দেয়। মেয়েটিকে ধর্ষনের চেষ্টা করে। তবে মেয়েটি কোনমতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং তার বন্ধু বান্ধব কয়েকজন মিলে তাকে উদ্ধার করে।
এবিষয়ে সালিশকারীদের একজন মৎস্য ব্যবসায়ী রবি বড়ুয়া সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানির কথিত অভিযোগে ক্লাব ঘরে গ্রাম্য সালিশে সুজন বড়ুয়াকে অমানবিক নির্যাতন করে জুতার মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানোর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি হাসপাতালে রোগী নিয়ে ব্যস্ত আছেন বলে ফোনের সংযোগ বিছিন্ন করে দেয়।
এবিষয়ে নামপ্রকাশ না করার শর্তে দেবাশীষ নগরের স্থানীয়রা জানান, প্রয়াত মানবেন্দ্র নায়ারন লারমা বা এমএন লারমা মানবতাবাদী পাহাড়ের জনগণের একজন মহান নেতা উনার নামে পাঠাগারের নাম দিয়ে এলাকায় রাজনৈতিক ক্লাব ঘর করে মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। যারা এ ক্লাব পরিচালনা করে তারা সকলে উগ্র মৌলবাদি একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত এবং এরা সবাই বহিরাগত। এসব বহিরাগতরা এলাকার স্থানীয় মুরব্বিদের সম্মান বা কোন মূল্যায়ন করে না। দেবাশীষ নগর স্থানীয় গ্রামবাসিরা আরো বলেন, সুজন বড়ুয়াকে জুতা দিয়ে মারপিট করে, জুতার মালা পরিয়ে গ্রামে ঘুরানো কোন বিচার বা সালিশী নয়, এটা সুজন বড়ুয়ার প্রতি নির্যাতন এবং বড়ুয়া জনগোষ্ঠীর প্রতি আক্রোশ মিটানো ছাড়া আর কিছু নয়। যারা বিচারের নামে মানবধিকার লংঘন করে অমানবিক নির্যাতন, জুতা দিয়ে ইচ্ছামত পিঠিয়ে পরে জুতার মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানোর পর তাকে গুম করে রেখেছে তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি স্থানীয়দের।
এবিষয়ে এশিয়া ছিন্নমুল মানবধিকার বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশনের প্রধান উদেষ্টা, বাংলাদেশ মানবধিকার কমিশনের তিন পার্বত্য জেলার সম্বয়নকারী ও দৈনিক গিরিদর্পণ পত্রিকার সম্পাদক একেএম মকছুদ আহমেদ বলেন, বিচার সালিশের নামে পায়ের জুতা দিয়ে প্রহার করা এবং একজন মানুষের গলায় জুতার মালা পরানো চরম মানবধিকার লংঘন। সভ্য সমাজে পাহাড়ে এখনো বরবর্রতা রয়ে গেছে, যারা বিচার সালিশের নামে মানবধিকার লংঘন করেছে তাদের দ্রুত সময়ে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরী।
স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানির কথিত অভিযোগে ২০-৩০ জন লোক গ্রাম্য সালিশে মৃত যতিন্দ্র লাল বড়ুয়ার ছেলে সুজন বড়ুয়া (৩৫) কে প্রথমে ক্লাব ঘরে ভিতর অমানবিক নির্যাতন, জুতা দিয়ে ইচ্ছামত পিঠিয়ে পরে জুতার মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানোর বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম (হাই কোর্ট বিভাগ) ও চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবি মোস্তফা কামাল বলেন, সালিশকারীরা আইন হাতে তুলে নিয়ে চরম অন্যায় এবং ফৌজদারী অপরাধ করেছে। এছাড়া সালিশকারীা দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি বৃদ্ধা আঙ্গুলি দেখিয়ে আইনকে অসম্মান করেছে এবং জুতার মালা পরানের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো এটা দন্ড বিধি আইন ও সাইবার আইনের সুস্পষ্ট অপরাধ সংগঠিত করেছেন।
এবিষয়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পুলিশ সুপার মীর মোদ্দাছ্ছের হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এধরনের ঘটনার বিষয়ে তিনি প্রথম শুনেছেন, রাঙামাটি শহরের ভিতর স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানির কথিত অভিযোগে গ্রাম্য সালিশে এক যুবককে ক্লাব ঘরে ভিতর অমানবিক নির্যাতন, জুতা দিয়ে ইচ্ছামত পিঠিয়ে পরে জুতার মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানোর দৃশ্য ফেইজবুকে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি। তার পরও এধরনের জঘন্য ঘটনার বিষয়ে তিনি ক্ষতিয়ে দেখবেন এবং অপরাধিদের আইনের আওতায় আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে জানান পুলিশ সুপার।
গ্রাম্য সালিশে মৃত যতিন্দ্র লাল বড়ুয়ার ছেলে সুজন বড়ুয়া (৩৫) কে অমানবিক নির্যাতন, জুতা দিয়ে ইচ্ছামত পিঠিয়ে পরে জুতার মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানো সালিশকারীদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় জানাগেছে, তারা হলেন : মিলন চন্দ্র চাকমা, পিতা- নোয়াচাঁন চাকমা, খুকুমনি দেওয়ান, পিতা- মৃত নীলাময় দেওয়ান, রবি বড়ুয়া, পিতা- পাখি বড়ুয়া এরা সকলেই রাঙামাটির দেবাশীষ নগরের বাসিন্দা।
স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানির কথিত অভিযোগে মানবধিকার লংঘন করে গ্রাম্য সালিশে যুবককে মধ্য যুগীয় কায়দায় অমানবিক নির্যাতন করে জুতার মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানো দৃশ্য ভিডিও ধারন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইজবুকে ভাইরাল হওয়ার ৬দিন পরেও রাঙামাটি কোতয়ালী থানা পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
এঘটনায় দেবাশীষ নগর এলাকায় স্থানীয়দের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।