শনিবার ● ১৯ মার্চ ২০২২
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » বিশ্বনাথে দশঘরে টিকে আছে ঐতিহ্যের গরুবারি
বিশ্বনাথে দশঘরে টিকে আছে ঐতিহ্যের গরুবারি
মো. আবুল কাশেম, স্টাফ রিপোর্টার :: গ্রামীণ ঐতিহ্যের অন্যতম একটি বাহক গরুবারি। দৈনিক পৃথিবীতে জ্যামিতিকহারে মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে ঘরবাড়ি। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ভবন। কমার্শিয়াল যুগে দিনকে দিন ফসলি জমি কমে যাওয়ার ফলে যান্ত্রিক পৃথিবী থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার পথে গ্রাম বাংলার অনেক ঐতিহ্য।
এক এক করে যখন প্রায় সকল ঐতিহ্য যাদুঘরে যাওয়ার পথে ঠিক তখন সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার দশঘর ইউনিয়নের দশঘর গ্রামের বাসিন্দারা ধরে রেখেছেন পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া শত শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যের গরুবারি।
খুব ছোটবেলা আমাদের নিহালের নোয়াগাঁও গ্রামের গরুবারির সাথে দশঘর গ্রামের গরুবারির গরু মিশে যাওয়ার ভয়ে আমরা মাঝখানে রাস্তায় পাহারা রাখতাম। যাতে এক বারির গরু অন্য বারিতে না ঢুকে। আবার এমন পাহারাও থাকতো যাতে যার যার সীমানায় যার যার গরু চরায়।
আশপাশের যেসকল গ্রামের বড়ো বন ছিল তারাও প্রায় সকলে অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষের প্রথম দিকে শুরু করে চৈত্রের শেষ বা বৈশাখের প্রথম দিকে গরুবারি বন্ধ করতো।
গরুবারি চলতো পালাক্রমে। প্রতিদিন গ্রামের দুই ঘরের লোক পালা করে গরু রাখালি করবে। যে দুই ঘরের পালা আসতো তারা হয় নিজে পাহারা দিতো না হয় লোক ভাড়া করে সারাদিন গরু রাখালি করাতো।
বাদ ফজর থেকে গরু রাখালি শুরু করে আসরের আযানের সাথে সাথে রাখালি শেষ হতো। তারপর যার যার গরু তারা নিজে গিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতো। আমিও আমার কাজের লোকের সাথে অনেকবার গরুবারি দিতে সারাদিন বনে কাটিয়েছি।
ঐতিহ্যের এই গরুবারিতে মানুষ কতটুকু লাভবান হতো সেটা আজকের অনেকে হয়তো বুঝতেই পারবে না। কারণ এখন অনেকেই বানিজ্যিকভাবে গরু লালন পালন করে তাই তাদের আর গরুবারি প্রয়োজন পড়ে না।
তাছাড়া অনেকে চাইলেও হয়তো গরুবারি করতে পারে না কারণ গরুবারির জন্য যে পরিমাণ খোলা বন বা জায়গা প্রয়োজন সে পরিমাণ বন হয়তো এখন নেই।
তখনকার সময় মানুষ হালচাষের জন্য দামড়া, মাইরের জন্য ষাঁড়, দুধ এবং বাচ্চা উৎপাদনের জন্য গাভী পালন করতো। আজকের মতো তখন গরুকে মোটাতাজা আর মাংসের জন্য লালন পালন করা হতো না। তাই তাদের সারাদিন গরুর পেছনে পেছনে লেগে থাকতে হয়নি।
কোনোমতে গরুকে তার কাজের জন্য শারিরীকভাবে সুস্থ রাখতে পারলেই হতো।
গরুবারির সিজন বন্ধ হয়ে গেলে তখন সবাই আলের ঘাস, ক্ষেতের ঘাস, বর্ষায় নৌকা করে বিল-ঝিলের ঘাস কেটে গরুকে খাওয়াতো। সন্ধ্যায় হয়তো চালের কুড়া পানিতে মিশিয়ে খাওয়াতো। মুখে রুচি হওয়ার জন্য গুড়ের ছিটা কুড়ার সাথে মিশিয়ে দিতো।
সমষ্টিগত গরুবারি মানুষকে সারাদিন গরুর পেছনে না রেখে সাংসারিক কাজকর্ম নির্বিগ্নে সম্পাদন করার সুযোগ করে দিতো। পুরো তিনমাসে বড়জোর এক থেকে দুদিন বা তিনদিন মানুষ গরুর পেছনে খরচ করেছে।
বাকিটা সময় সাংসারিক কাজে ব্যয় করতে পেরেছে। অথচ এখন গরুবারি উঠে যাওয়ায় সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। সকাল সন্ধ্যা গরুর পেছনেই কাটাতে হচ্ছে তাদের।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা গ্রামীণ এই ঐতিহ্য আর কতদিন ধরে রাখতে পারে দশঘরের মানুষ সেটাই এখন দেখার বিষয়।