শুক্রবার ● ২৫ মার্চ ২০১৬
প্রথম পাতা » জাতীয় » ২৫ মার্চ রাতে ইপিআর ক্যাম্পে যুদ্ধ করে শহীদ হন নাটোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আকরাম আলী
২৫ মার্চ রাতে ইপিআর ক্যাম্পে যুদ্ধ করে শহীদ হন নাটোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আকরাম আলী
আব্দুল মজিদ, নাটোর প্রতিনিধি :: নাটোরের এক অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা তদানিন্তন ইপিআর এর জুৃনিয়র কমিশন অফিসার (জেসিও) খন্দকার আকরাম আলী ২৫ মার্চ পিলখানা ক্যাম্পেই শহীদ হন৷ শহীদ খন্দকার আকরাম আলীর জন্ম নাটোর জেলার সিংড়ার ছাতারদিঘী ইউনিয়নের ছাতারবাড়ীয়া গ্রামে৷ তাঁর শৈশব কেটেছে ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে৷ বাবা খন্দকার এরশাদ আলী, মা ছয়রন বেগমের পাঁচ ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সন্তান৷ তিনি তত্কালীন ইপিআর অর্থাত্ বর্তমান বিজিবি’তে জুনিয়র কমিশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন৷ তাঁর কর্মস্থল ছিল ইপিআর এর সদর দপ্তর ঢাকার পিলখানায়৷ তিনি এই সুশৃঙ্খল বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেও একজন বাঙালি হিসাবে দেশমাতৃকাকে ভালোবাসতেন বলে সুযোগ পেলেই পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন৷ আর তাঁর পশ্চিমাবিরোধী এই মনোবৃত্তির কারণে তাকে মাঝে মধ্যেই যেমন পাকিস্তানীদের রোষানলে পড়তে হতো ঠিক তেমনই বাঙালি জোওয়ানদের কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ৷ সামরিক বাহিনীতে কর্মরত থেকেও তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ছয় দফার সমর্থনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ব্যাটেলিয়ানকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন৷ রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে তিনি তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা অসংখ্য বাঙালী জওয়ানদের পরিবারকে নৌকা মার্কায় ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করেন৷ রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ তিনিসহ অনেক বাঙালি সৈন্যরাই সেদিন সিভিল পোশাকে চুপিচুপি সেখানে গিয়েছিলেন৷ এব্যাপারগুলো ক্ষুদ্র মনে হলেও তখনকার প্রেক্ষাপটে তাঁর জন্য ছিল ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক৷ খন্দকার আকরাম আলী সাধারণ বাঙালি সৈনিকদের সাহস ও প্রেরণা যোগাতেন বলে গোয়েন্দা নজরদারীতে থাকার পরেও অতি সঙ্গোপনে তাঁরা নিজেদের মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন৷ এই বিষয়টি পশ্চিমাদের নজরে চলে এলে ২৫ মার্চ কালরাত্রির আগেই বাঙালি সৈনিক ও অফিসারদের নিরস্ত্র করার প্রক্রিয়া শুরু হলে গোপনে সদর দপ্তরের আনাচে-কানাচে সমাবেশের আয়োজন৷ এ বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তাঁকে মালখানা অর্থাত্ অস্ত্রাগারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে জানতে পেরে তিনি মালখানার একাধিক চাবি সংগ্রহ করে তিনি গোপনে তাঁর বিশ্বস্ত কিছু অনুচরদের কাছে রাখার ব্যবস্থা করেন যাতে বিপদের সময়ে দরকার পড়লে কাজে লাগানো হয়৷ বিষয়টি তিনি পারিবারিক ভাবে আলোচনা করেছিলেন৷ তিনি সে সময় পরিবার নিয়ে ইপিআর সদর দপ্তরে অবস্থান করছিলেন, কিন্তু ২২ মার্চ থেকে তাঁকে নিরস্ত্র করে সদর দপ্তর থেকে বাইরে যাওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷ তিনি পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে তার বাড়ির উঠানে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন৷ বেশ কিছু জোওয়ান ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেলেও তাঁরা অনেকে হেড কোয়ার্টারেই অবস্থান করেছিলেন৷ আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে তত্কালীন ইপিআর-এ কর্মরত বাঙালিরাই প্রথম দিকে প্রতিরোধ করে৷তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন ঠিক কোন সময় কখন তাঁদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে মরণপণ সংগ্রামে সেই মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়৷ ২৫ মার্চ বিকালের মধ্যেই আর্মি ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তাঁরা খবর পেয়ে যান বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ভুট্টু আর ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে পালিয়ে যাবার পর গভীর রাতে পাক সেনারা পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন সহ বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র আক্রমণ চালাতে পারে৷ এসময় ইপিআর এর হেডকোয়ার্টারের ভেতরে থাকা ১৫নং ব্যাটিলিয়নের বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আকরাম আলীর নেতৃত্বে একটি কমান্ড গঠন করা হয়৷ তাঁর নেতৃত্বে ২৩ মার্চ ইপিআর হেড কোয়ার্টারের ১১ নম্বর প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে একটি গাছের মাথায় উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা৷ বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাত্রিতে বন্দি করা হলে তাদের পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক মালখানার অস্ত্র বাঙালিরা লুট করে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে দেয়৷ ইপিআর ক্যাম্পে ট্যাঙ্ক, মর্টার, কামান ও বিমান বাহিনী নির্বিচারে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে৷ তাঁরাও প্রাণপণে লড়ে যায়৷ পাক হানাদারদের উন্নত অস্ত্রের সাথে টিকতে না পেরে অনেক সৈনিক শহীদ হন৷ সেই রাতে নাটোরের এই বীর যোদ্ধা খন্দকার আকরাম আলীও শহীদ হন৷ তিনি নাটোরের মানুষ হলেও নাটোরে তাঁকে অবহেলা করে কখনও তাকে স্মরণ করা হয়না৷