শুক্রবার ● ১৭ জুন ২০২২
প্রথম পাতা » খাগড়াছড়ি » পাহাড়ের সংঘাত বন্ধে নতুন ‘শান্তি চুক্তি’র প্রস্তাব দিয়েছে ইউপিডিএফ
পাহাড়ের সংঘাত বন্ধে নতুন ‘শান্তি চুক্তি’র প্রস্তাব দিয়েছে ইউপিডিএফ
অনলাইন ডেস্ক :: দুই যুগ আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশকারী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মূল) পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা হানাহানি বন্ধে নতুন চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে৷
সংগঠনটি মধ্যস্ততাকারীর মাধ্যমে সরকারের কাছে পেশের জন্য এই লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে৷ প্রস্তাবে বর্তমান শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণের দাবি করা হয়েছে৷ প্রয়োজনে পাহাড়ের সব পক্ষকে নিয়ে সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসতেও আপত্তি নেই জানানো হয়েছে৷
পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও রক্তপাত বন্ধে চেষ্টা করছেন জানালেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এখনই ইউপিডিএফের এই প্রস্তাবের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি৷
পাহাড়ে বিদ্রোহ আর রক্তক্ষয় অবসানে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) এর সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার৷
তখন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) নেতৃত্বাধীন জেএসএসের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ ছিল পাহাড়িরা৷ কিন্তু চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালে প্রসিত বিকাশ খিসার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ইউপিডিএফ৷
তারপর পিসিজেএসএস-ইউপিডিএফ দ্বন্দ্বে পাহাড়ে অনেক রক্ত ঝরেছে৷ শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সন্তু লারমার ক্ষোভের মধ্যে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যেও দেখা দেয় বিভাজন৷ পিসিজেএসএস আবার ভেঙে গড়ে ওঠে পিসিজেএসএস (এমএন লারমা-সংস্কারপন্থী) ৷ প্রসিত বিকাশ খিসার দল ভেঙেও গড়ে ওঠে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি সংগঠন৷ গত কয়েক বছরে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে অশান্তি চলার মধ্যেই শান্তির প্রস্তাব নিয়ে এল ইউপিডিএফ৷
গত ৯ জুন খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ২ নম্বর চেঙ্গী ইউনিয়নের বড়কলক এলাকায় এক অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফের পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা এ দাবিনামা হস্তান্তর করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. এমদাদুল ইসলামের কাছে৷
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি ইউনিটের সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, সরকারের ‘প্রতিনিধিদের’ সঙ্গে ২০১৯ সাল থেকে কয়েক দফা আলোচনার পর এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে৷
কেন এখন এই প্রস্তাব এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে ৷ এত বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না ৷ চুক্তির কিছু অসঙ্গতি দূর করারও বিষয় আছে৷ নানা কারণে পরিস্থিতি খুব নাজুক ৷ তাই আমরা নতুন চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছি৷ ’’
সেই মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকায় থাকা সাবেক সেনা কর্মকর্তা এমদাদুল ইসলাম ‘দীর্ঘদিনের’ আলোচনা শেষে ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ লিখিত প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন ৷
এমদাদুল ইসলাম কর্মরত অবস্থায় পার্বত্য শান্তি চুক্তি আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন ৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে পদায়িত হয়ে মিয়ানমারে হেড অব মিশন হিসেবে কাজ করেন ৷ পরে কঙ্গোতে শান্তি রক্ষী মিশনেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি৷
পার্বত্য চট্টগ্রাম: শাসন ও সংঘাতের ইতিহাস
আরাকান ও ত্রিপুরা রাজের লড়াই
৯৫৩ সালে এখনকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজার দখলে৷ তিনশ বছরের শাসনের পর ১২৫৩ সালে তাদের কাছ থেকে তৎকালীন ত্রিপুরার রাজা অঞ্চলটি দখল করে নেয়৷ ১৫৭৫ সালে আবার দখল ফিরে পায় আরাকানরা৷ ১৬৬৬ সালে তাদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ নেয় মুঘলরা৷
এমদাদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘অনেকদিনের চেষ্টার ফসল এটি ৷ দীর্ঘ সময় ধরে তাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে৷ তারা প্রস্তাবনা তৈরি করেছে সময় নিয়ে৷ এরপর আমাদের দিয়েছে৷”
ইউপিডিএফের প্রস্তাব শিগগিরই সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছানো হবে বলে এক জানান তিনি৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আপনি যেমন শুনেছেন, আমিও শুনতে পাচ্ছি ৷ অগ্রগতি তখনই বলি, যখন একটা কিছু হয় ৷ এটা এখনো লিকুইড স্টেজে৷ একটা কিছু ফর্ম করুক, তারপর বলব৷ যা করার… পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই চেষ্টা করছি৷ পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করছি৷ ”
প্রস্তাবটি পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা এখনই এ বিষয়ে বলতে পারছি না৷ ’’
প্রস্তাবে যা আছে
চুক্তির আকারে পেশ করা ইউপিডিএফের দাবিনামায় আটটি ভাগ আছে৷ ৬৬ পৃষ্ঠার ওই প্রস্তাবে মোট ৮৭টি দাবি এবং প্রত্যেক দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷
দাবিনামার ভাগগুলো হলো- সাংবিধানিক অবস্থা, সাংবিধানিক আইন ব্যতিত অন্যান্য কতিপয় আইনের রহিতকরণ ও সংশোধন, সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৮৮ এর সংস্কার, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সমূহের সংস্কার, পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন, পুনর্বাসন মামলা প্রত্যাহারসহ অন্যান্য বিষয় এবং চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি ও চুক্তি বলবৎকরণ৷
ইউপিডিএফ সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে গত কয়েক বছর ধরে চলমান সংঘাতে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত৷
তিনি বলেন ‘‘তারপরও আমরা সহনশীল৷ কীভাবে সংঘাত বন্ধ করে পার্বত্য জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় সে চেষ্টায় আছি৷ সরকারও আন্তরিকতা দেখাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে৷ কথা বলার অবস্থা তৈরি হচ্ছে৷ তাই সরকারের সাথে ডায়লগে যাওয়ার আগে এই প্রস্তাব৷ ’’
বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের কোনো সংলাপ হলে সব পক্ষের উপস্থিতি প্রয়োজন উল্লেখ করে অংগ্য বলেন, ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক সমাধান চাইলে সবাইকে নিয়ে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই৷”
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছেও চিঠি পাঠিয়েছেন বলে জানান অংগ্য মারমা৷
তিনি বলেন, ‘‘চিঠি দেওয়া সংলাপে যাওয়ার আগে একটা স্বাভাবিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়া৷ আমাদের দাবিনামায় শান্তি চুক্তির বিষয়গুলোও যে উল্লেখ আছে তা উনাদের জানিয়েছি৷ যদি তারা মনে করেন একসাথে কাজ করার মতো অবস্থা আছে৷ তাহলে সবপক্ষের উপস্থিতিতেই সংলাপ হতে পারে৷ ’’
তবে ইউপিডিএফের এই প্রস্তাবের বিষয়ে কথা বলতে সন্তু লা্রমা নেতৃত্বাধীন পিসি জেএসএসের শীর্ষ পর্যায়ের তিনজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে৷
এনিয়ে এখনই মন্তব্য করতে রাজি নন৷ তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেএসএসের অন্য এক নেতা৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ।