বৃহস্পতিবার ● ১৩ জুন ২০২৪
প্রথম পাতা » অপরাধ » রাঙামাটিতে শিশু হত্যার অপরাধে অংবাচিং মারমাকে মৃত্যুদণ্ড
রাঙামাটিতে শিশু হত্যার অপরাধে অংবাচিং মারমাকে মৃত্যুদণ্ড
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: আজ ১৩ জুন-২০২৪ বৃহস্পতিবার ধর্ষনের চেষ্টা ও ৯ বছরের শিশুকে হত্যার অপরাধে রাঙামাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আসামির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করেন।
ভিকটিমকে ধর্ষনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ৯ বছরের নিষ্পাপ শিশুকে হত্যার অপরাধে আসামি অংবাচিং মারমা প্রকাশ আবাসু প্রকাশ বামং (৪৬), পিতা- উচাখ্যাই মারমা, মাতা- উসাং মারমা, গ্রাম- বড়খোলা পাড়া, থানা- চন্দ্রঘোনা,জেলা- রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাসিন্দা বামং-কে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (৪) (খ) ধারার অপরাধের দায়ে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং পেনাল কোড, ১৮৬০ এর ৩০২ ধারা অপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ড এবং ১ লক্ষ টাকা জরিমানার দন্ড প্রদান করা হয়। আসামির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন রাঙামাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এর বিচারক এ. ই. এম. ইসমাইল হোসেন (জেলা ও দায়রা জজ) আদালত।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ জানাযায়, মামলার বাদি সাধুই অং মারমা রাঙামাটি পার্বত্য জেলার চন্দ্রঘোনা থানাধীন ২ নং রাইখালী ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের অধীন পূর্ব কোদালা গ্রামের বাসিন্দা। তার ৯ বছর বয়সী শিশু কন্যা মিতালী মারমা এই মামলার ভিকটিম। ঘটনার সময় সে পূর্ব কোদালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। আসামি অংবাচিং মারমা প্রকাশ আবাসু প্রকাশ বামং ভিকটিমের প্রাইভেট শিক্ষক। আসামি পূর্ব কোদালা বদ্দর পাড়ায় তার মামা ডাঃ অং সুইপ্রু মারমার ঘরে শিশুদের প্রাইভেট পড়াতেন। ঘটনার দিন গত ০২-০২-২০১৯ ইংরেজি তারিখ সকাল ৮ থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে এজাহারকারী তার মেয়েকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য আসামির কাছে দিয়ে আসেন। সেখানে বিভিন্ন স্কুলের আরো ৪ জন ছাত্র-ছাত্রী প্রাইভেট পড়ত। আসামি সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে অন্য বাচ্চাদের ছুটি দিয়ে ভিকটিমকে আরও পড়ানোর অযুহাতে রেখে দেন। এরপর আসামি ভিকটিমকে একা পেয়ে ধর্ষণ করতে চাইলে ভিকটিম কান্নাকাটি শুরু করে ও চিৎকার দেয়। আসামি তখন ক্ষিপ্ত হয়ে ভিকটিমের মুখ চেপে ধরে এবং এক পর্যায়ে ভিকটিমের গলায় সুতলি ও কাপড়ের ব্যাগের ফিতা দিয়ে প্যাঁচিয়ে ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করে। তারপর ভিকটিমের লাশ গোপন করার উদ্দেশ্যে তা চটের বস্তায় ভরে ঘরের মাচার উপর তুলে রাখে। ভিকটিম প্রাইভেট পড়া শেষে স্কুলে গিয়ে সেখান থেকে বিকাল ৪টার বাসায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু সে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পর্যন্ত ফিরে না আসায় এজাহারকারী ও তার স্ত্রী এবং পাড়া প্রতিবেশী মিলে ভিকটিমকে খুঁজতে থাকেন। তারা আসামির নিকট ভিকটিমের অবস্থান জানতে চাইলে আসামি তাদের তাকে বলে যে, ভিকটিম পড়াশুনায় দুর্বল হওয়ায় তিনি তাকে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট পড়িয়ে ছুটি দিয়েছেন। আসামির আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় এজাহারকারী ও তার সঙ্গীয় লোকজন আসামীর বাড়ীর চারপাশে পাহারা দিতে থাকেন। গত ০২-০২- ২০১৯ ইংরেজি তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ ০৩-০২-২০১৯ ইংরেজি তারিখ ভোর অনুমান ৪টার সময় আসামি ঐ বাড়ী থেকে ভিকটিমের লাশ ভর্তি বস্তা নিয়ে বের হলে এজাহারকারীসহ সাক্ষীগণ তাকে বস্তাসহ আটক করেন। এজাহারকারী ও উপস্থিত লোকজন ভিকটিমের লাশ দেখতে পায়। তারা আসামিকে বেঁধে ফেলে। আসামি সেখানে গণপিটুনির শিকার হয়। এই বিষয়ে থানার সংবাদ দেয়া হলে চন্দ্রঘোনা থানার এস আই মোঃ ইস্রাফিল আসেন এবং ভিকটিমের লাশসহ আসামিকে জনগণ কর্তৃক আটককৃত অবস্থায় পান। তিনি আসামিকে গ্রেফতার কারে কাপ্তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থানায় আসেন। থানার আসামির বিরুদ্ধে ভিকটিমকে ধর্ষণ ও হত্যা করার অভিযোগে এজাহার দায়ের করেন। তৎপ্রেক্ষিতে চন্দ্রঘোনা থানার ওসি মোঃ আশরাফ উদ্দিন আসামি অংবাচিং মারমা প্রকাশ আবাসু প্রকাশ বামং এর বিরুদ্ধে চন্দ্রঘোনা থানার মামলা নং- ০১, তারিখ- ০৩-০২-২০১৯ ইংরেজি, ধারা-নারী ও শিশু নির্যাত দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (২) তৎসহ পেনাল কোড, ১৮৬০ এর ২০১ রুজু করেন। মামলার তদন্তভার এস আই মোঃ ইস্রাফিল এর উপর অর্পণ করা হয়।
তদন্তকালে আসামি বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট জাহেদ আহমদ এর নিকট ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারা মোতাবেক দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান বলেন যে, তিনি ভিকটিমকে ধর্ষণ করতে চাইলে সে কান্নাকাটি ও চিৎকার করায় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন এবং তার লাশ বস্তায় ভরে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
মামলার আইও আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টা, হত্যা ও লাশ গুমের চেষ্টার অপরাধের বিচারের জন্য চন্দ্রঘোনা থানার অভিযোগপত্র নং-১১, তারিখঃ ০৫-০৮-২০১৯ ইংরেজি, ধারা- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (৪) (খ) ও তৎসহ পেনাল কোড, ১৮৬০ এর ধারা ৩০২ ও ২০১ দাখিল করেন।
রাষ্ট্র পক্ষ মামলা প্রমানের জন্য মোট ২০ জন স্বাক্ষী উপস্থাপন করে।
রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থাপিত মৌখিক সাক্ষ্য, দালিলিক সাক্ষ্য, মেডিক্যাল সাক্ষ্য, ফরেনসিক সাক্ষ্য ও ঘটনার পারিপার্শ্বিক অবস্থাগত সাক্ষ্য বা Circumstantial evidence পর্যালোচনা করে আদালত আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (৪) (খ) ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং সর্বনিম্ন শাস্তি ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং তৎসহ অর্থদন্ড। ১৮৬০ সালের পেনাল কোড এর ৩০২ ধারার অপরাধের সাজা মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং তৎসহ অর্থদন্ডিত করেন।
রাঙামাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার পর এ প্রথম কোন অপরাধিকে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করেন।
রাষ্ট্র পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন বিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট মোঃ রফিকুল ইসলাম ও বিজ্ঞ বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট মোঃ সাইফুল ইসলাম অভি।
আসামি পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন এ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুন ও এ্যাডভোকেট ঊষাময় খীসা।
আসামি পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী এ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুন আজকের এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানান।
এ মামলার বাদি সাধুই অং মারমা আসামি অংবাচিং মারমা প্রকাশ আবাসু প্রকাশ বামং-কে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায়ে তিনি খুশি বলে জানান গণমাধ্যমকে।