বুধবার ● ২০ নভেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের ৪৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত
ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের ৪৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত
ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের দপ্তর সম্পাদক তুফান চাকমা প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, “জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে লড়তে হবে জনগণকেই” এই ব্যানার শ্লোগানে ‘ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদ’-এর প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে ৪৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটি ও ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪ সকাল ১০টায় রাঙামাটি সদর উপজেলায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সাজেক, রামগড়, পানছড়ি, লংগদুসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিরা এতে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, হেডম্যান, সাবেক ও বর্তমান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, কার্বারী, গৃহিনীও রয়েছেন।
সম্মেলনের ১ম অধিবেশনে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হরি কুমার কার্বারীর সভাপতিত্বে ও নির্মল চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন সাজেক গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব বাবুধন চাকমা, রূপকারী মৌজার হেডম্যান বিশ্বজিৎ চাকমা, ২নং চেঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অনিল চন্দ্র চাকমা, ৫নং ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আপ্রুসি মারমা, সাজেক গণ অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নতুন জয় কার্বারি ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি তেরেসা চাকমা।
এ সময় মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি তুফান চাকমা ও কুশর ত্রিপুরা।
সম্মেলনের ২য় অধিবেশনের শুরুতে উপস্থিত সকল প্রতিনিধিদের কন্ঠ ভোটে উষাতন চাকমাকে সভাপতি ও অনিল চন্দ্র চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ৪৭ সদস্য বিশিষ্ট ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের “কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটি” গঠন করা হয়।
এছাড়া এতে বিশ্বজিৎ চাকমাকে প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
সম্মেলনে গঠিত ছাত্র-জনতার কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি উষাতন চাকমা বলেন, “ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পন্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিসত্তাগুলোর ন্যায্যতা ও অধিকারের পক্ষে কাজ করবে। আজকের এই সম্মেলন থেকে আমি বলতে চাই, পাহাড়ের সব রাজনৈতিক দল জনগণের অধিকারের কথা বললেও আমরা সবকিছু জানি কারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের পক্ষে আন্দোলন পরিচালনা করছে।
“যারা জনগণের অধিকারের জন্য সৎভাবে আন্দোলন করছেন আপনাদের সাধুবাদ। আর যারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন এখনো সময় আছে জনগণের কাতারে চলে আসুন। জনগণের আশা-প্রত্যাশা, হাহাকার বুঝার চেষ্টা করুন।”
তিনি ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের সবাইকে হাতে হাত রেখে জাতির জন্য কাজ করার আহ্বান জানান।
আপ্রুসি মারমা বলেন, আজ পাহাড়ের একটাই গণদাবি, সেটা হচ্ছে ‘এগত্তর বা ঐক্য’। আমি মনে করি আগে জনগণকে এগত্তর হতে হবে।
তিনি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা তুলে ধরে বলেন, আমরা দেখেছি একজন মোটর সাইকেল চোরকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলায় ৪টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। পাহাড়িদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আমার সোজা কথা আমাদের আজকের সম্মেলনে যে কথাবার্তা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে তা যাতে নিজের এলাকায় গিয়ে বাস্তবায়ন করি, নয়তো এই সম্মেলন অনর্থক হবে।
অনিল চন্দ্র চাকমা বলেন, আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে আনা। আর এই অধিকার অর্জনের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের গঠন তখনই স্বার্থক হবে যখন সকল অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সমুচিত জবাব দিতে পারবো। অন্যথায় বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে অধিকার অর্জন করা যাবে না।
তিনি আরো বলেন, জেএসএসের গঠনের সময় বোধ জ্ঞান না থাকলেও লাম্বা-বাধি গৃহযুদ্ধের সময় বোধ জ্ঞান হয়েছিল। তখন দেখেছি গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা। সোনা যেভাবে পুড়ে পুড়ে খাটি হয়, ইট যেভাবে পুড়ে পুড়ে শক্ত হয় টিক সেভাবে আমরাও অনেক কষ্ট, দুর্যোগের সম্মুখীন হয়ে অভিজ্ঞতায় শাণিত হয়েছি। সুতরাং ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেই পাহাড়ে অধিকারের আন্দোলন এগিয়ে নেয়া সম্ভব।
বিশ্বজিৎ চাকমা বলেন, আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া কোন কিছু অর্জিত হয় না, কেউ কাউকে এমনিতে অধিকার দেয় না। এটা চরম সত্য। লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে। অধিকার ছিনিয়ে আনতে পারলে তবে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব হবে। দুই দশকের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় কাঙ্খিত আশা পূরণ হয়নি। আজকে এখানে যারা উপস্থিত আমরা সবাই সচেতন, তাই আমাদের জাতীয়ভাবে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের অবশ্যই এই গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা যদি এই দায়িত্ব পালন না করি তাহলে ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে আমাদের লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আমরা প্রবীণরা আমাদের দায়িত্ব অবশ্যই যথাযথভাবে পালন করবো। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের দলগুলোকে আহ্বান করবো ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার জন্য।
বাবুধন চাকমা বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা মুক্ত বাংলাদেশে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীও আশায় বুক বেঁধেছিলাম, কিন্তু তা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর ফ্যাসিস্ট হাসিনার নীলনক্সা এখনো জারি রয়েছে। আমরা সাজেকবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে রয়েছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়িত জনগণের অধিকার অর্জনের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের বিকল্প নেই।
তেরেসা চাকমা বলেন, আমার বাবাও পাহাড়ের অধিকার সংগ্রাম করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। তিনি আমাকে জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন নামক অরাজনৈতিক একটা প্লাটফর্ম থেকে যখন খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ‘এগত্তর’সহ চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে দুটি বড় সমাবেশ করা হয় তখন জেএসএস থেকে বলা হয়েছে এই সংগঠন নাকি ইউপিডিএফের ছায়া সংগঠন। আর গত ১৫ নভেম্বর তো খাগড়াছড়িতে সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। এভাবে তো অধিকারের আন্দোলন হবে না।
তিনি সামনের দিনগুলোতে নিজের জাতির অধিকার রক্ষার্থে কাজ করে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ৬ আগস্ট ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদ প্রথম রাঙ্গামাটিতে গণসমাবেশ করতে চাইলে সন্তু লারমার জেএসএস ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে বাধা দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সকল দলের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে পরিচালিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার ও রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে এই গণসমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছিল।