মঙ্গলবার ● ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » দীপংকর তালুকদার এর অবৈধ সম্পদের তদন্তে নেমেছে দুদক
দীপংকর তালুকদার এর অবৈধ সম্পদের তদন্তে নেমেছে দুদক
ডেক্স রিপোর্ট :: ১৯৯১ সাল থেকে একটানা নির্বাচন করে আসছেন রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার। এর মধ্যে দুবার পরাজিত হলেও জয়ী হয়েছেন পাঁচবার। এক মেয়াদে ছিলেন প্রতিমন্ত্রীও। ক্ষমতার মসনদে থাকায় তিনি দলে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন যে প্রকাশ্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা কথার বাইরে চলার সাহস দেখাননি নেতারা।
এই সুযোগে দীপংকর তালুকদার হয়েছেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। অভিযোগ রয়েছে, দীপংকর তালুকদার রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন, দলীয় বিভিন্ন সংগঠনের পদ-বাণিজ্য এবং এলজিইডি, উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরের উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য, ভুয়া পারমিটের আড়ালে কাঠ পাচার এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। আর এসব খাত থেকেই অনিয়ম ও দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
দৃশ্যমান কোনো আয়ের খাত না থাকলেও সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দেওয়া হলফনামায় পেশায় নিজেকে প্রথম শ্রেণির কাঠ ব্যবসায়ী ও সরবরাহকারী উল্লেখ করেছেন। যদিও সেই খাত থেকে কোনো আয় দেখাতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পে অনিয়মসহ দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে। তার এই অবৈধ সম্পদের তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২ অক্টোবর দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশন সভা থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রাঙামাটি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) মনে করছে, ‘চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ না থাকায় পৌনঃপুনিক দুর্নীতিটা আরও বেশি বেড়ে গেছে।’ আর রাঙামাটি জেলার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বলছে, ‘দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই সব স্তর থেকে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে।’
দীপংকরের এই অবৈধ সম্পদ অর্জনের বড় জোগানদাতা চার সহযোগী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী এবং সাবেক চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মুছা মাতব্বর, জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য রেমলিয়ানা পাংখোয়া। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই পলাতক রয়েছেন দীপংকরসহ এই নেতারা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দেওয়া দীপংকর তালুকদারের হলফনামার তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে মোট সম্পদ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫২ লাখ ১৯ হাজার ৩২৮ টাকা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি ৭৮ লাখ ৪৮ হাজার ৪৮৪ টাকা।
তবে গত পাঁচ বছরে তার বার্ষিক আয় কমেছে বিস্ময়করভাবে। ২০১৮ সালে বার্ষিক আয় ছিল ৯৮ লাখ ১০ হাজার ২৭৭ টাকা।
২০২৩ সালে দেখিয়েছেন ১৯ লাখ ৩৩ হাজার ২৯৭ টাকা। এ আয়ের মধ্যে বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান ও অন্যান্য ভাড়া ৫ লাখ ২৩ হাজার ৪০০ টাকা, শেয়ার সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত ১ লাখ ৯০ হাজার, এমপি সম্মানী ৬ লাখ ৬০ হাজার এবং ব্যাংক লভ্যাংশ ৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৭ টাকা।
অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে দীপংকর তালুকদার নিজের কাছে নগদ টাকা দেখিয়েছেন ১ কোটি ৭৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা, স্ত্রীর কাছে শুধু ১২ হাজার ৫০০ টাকা এবং নির্ভরশীলদের নামে ১০ লাখ ৩২ হাজার ৮৩৯ টাকা।
এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজের নামে জমা ৩৪ লাখ ৫২ হাজার ৪৩০ টাকা, স্ত্রীর নামে ৭৪ লাখ ৪৪ হাজার ১৭৬ টাকা এবং ৪ লাখ ৭৭ হাজার ২১৪ টাকা নির্ভরশীলদের নামে দেখিয়েছেন। সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতে দীপংকর নিজ নামে এফডিআর ৫৪ লাখ ও সঞ্চয়পত্রে ১ কোটি টাকা, স্ত্রীর নামে সঞ্চয়পত্র ৫০ লাখ টাকা, নির্ভরশীলাদের নামে এফডিআর ২০ লাখ এবং সঞ্চয়পত্রে ৫৫ লাখ টাকা।
২০১৮ সালে হলফনামায় দেওয়া তথ্যে নিজের নামে স্বর্ণ ছিল ২৫ ভরি, যার মূল্য দেখিয়েছিলেন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তখন স্ত্রীর নামে স্বর্ণ উল্লেখ করেননি। কিন্তু ২০২৩ সালের হলফনামায় নিজের ২৫ ভরির সঙ্গে স্ত্রীর আরও ২৫ ভরি স্বর্ণ দেখিয়েছেন। নিজের স্বর্ণের মূল্য ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেখালেও স্ত্রীর স্বর্ণের মূল্য দেখিয়েছেন ৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে স্ত্রীর অর্জিত এই স্বর্ণের ভরিপ্রতি মূল্য দেখানো হয়েছে ১২ হাজার টাকা করে। সব মিলিয়ে ৫০ ভরি স্বর্ণের মূল্য উল্লেখ করেছেন ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
নিজ নামে রয়েছে মোটরগাড়ি। দাম ৬৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৮ টাকা। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক সামগ্রীর মূল্য ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৭০০ টাকা। আসবাবপত্রের মূল্য দেখিয়েছেন ৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। হলফনামায় নিজের নামে দুটি অস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে জার্মানির তৈরি একটি ২২ বোর রাইফেল এবং ইতালির তৈরি একটি এনবিপি বিজেট বোর দুটির মূল্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
দীপংকর তালুকদারের নামে কোনো কৃষিজমি নেই। তবে জেলার রাজস্থলী উপজেলায় ২১ দশমিক ৩০ একর ও রাঙামাটি শহরের ঝগড়াবিল মৌজায় ২ দশমিক ২৩ একর জমির মালিক হয়েছেন কেবল দানসূত্রে! অথচ এই পরিমাণ জমির বর্তমান মূল্য উল্লেখ করেননি হলফনামায়। যদিও এসব জমির মূল্য কয়েক কোটি টাকা।
তার স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে অকৃষি জমি হিসেবে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর অনন্যা আবাসিক এলাকায় নিজ নামে পাঁচ কাঠার প্লট, যার মূল্য ৩৩ লাখ টাকা এবং স্ত্রীর নামে ছয়টি প্লট, যার মূল্য ১০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া রাঙামাটি শহরের চম্পকনগরের দীপালয় নামে পাঁচতলা দালান, যার মূল্য ৮৮ লাখ ৩২ হাজার ২৩৩ টাকা ও স্ত্রীর নামে একটি অ্যাপার্টমেন্ট, যার মূল্য ৮০ লাখ ১২ হাজার টাকা দেখালেও ওই অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা উল্লেখ করেননি।
আবার জেলার রাজস্থলী উপজেলায় ২১ দশমিক ৩০ একর জমি পেয়েছেন তার মায়ের কাছ থেকে। দানসূত্রে পাওয়া জমিতে রয়েছে পাল্পউড বাগান। এ ছাড়া রাঙামাটি সদরের ঝগড়াবিল এলাকায় দানসূত্রে পাওয়া ২ দশমিক ২৩ একর জমি উল্লেখ করলেও কার কাছ থেকে পেয়েছেন তার উল্লেখ নেই। আর এই দুই জমিরই মূল্য উল্লেখ করেননি দীপংকর। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বাগানসহ এসব জমির মূল্য অন্তত ২৫-৩০ কোটি টাকা হতে পারে।
২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর দেওয়া হলফনামায় এসব সম্পদের বাইরে দায়দেনার হিসাবও দিয়েছেন দীপংকর তালুকদার। রাঙামাটি শহরের বনরূপা এলাকায় ‘কল্পতরু হলিডে ইন লিমিটেড’ প্রকল্পের বিপরীতে অংশীদারি দায় ৫৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৫০ টাকা দেখিয়েছেন।
তবে দীপংকরের কাগুজে এই হিসাব বিশ্বাস করেন না রাঙামাটির বাসিন্দারা। তাদের ধারণা, এর কয়েক গুণ বেশি সম্পদ রয়েছে দীপংকরের। অবশ্য এই সম্পত্তির বাইরে বিপুল সম্পত্তি থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট। এর পরই দীপংকরের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পে অনিয়মসহ দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগে তদন্তে নেমেছে দুদক।
দুপ্রকের সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, ‘ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও একদলীয় শাসন হওয়ার কারণে সবাই অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে গেছে। চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ না থাকায় পৌনঃপুনিক দুর্নীতিটা আরও বেশি বেড়ে গেছে। এর প্রভাব রাঙামাটিতেও পড়েছে। সুশাসনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটমেন্ট না থাকায় প্রশাসনিক সহায়তায় দুর্নীতিগুলো রীতিমতো একটা কাঠামোবদ্ধ হয়ে গেছে। আমরা অবশ্যই চাইছি নিরপরাধ কেউ যেন হেনস্তার শিকার না হয়। কিন্তু প্রকৃত দুর্নীতিবাজও যেন ছাড় না পায়। সমাজে দুর্নীতি ও সুষম বণ্টনের সমস্যার কারণেই বৈষম্য হয়েছে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই তো জুলাই বিপ্লব হয়েছে। এই দুর্নীতি রোধ ও সুষম বণ্টনের জন্য সুশাসন দরকার।’
সুজনের রাঙামাটি জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট দীননাথ তংচংগা বলেন, ‘দুদক জনগণের আশার জায়গা। দুর্নীতি করে কেউ যেন বাদ না যান, সেই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে মাঠপর্যায়ে দুদক কর্মকর্তাদের সরিয়ে পুনর্গঠন করতে হবে। গতিশীল স্বচ্ছ অনুসন্ধান ও দুর্নীতিবাজ শনাক্তের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই সব স্তর থেকে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে।’
এ বিষয়ে জানতে দুদকের রাঙামাটি সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক জাহিদ কালামের মুঠোফোনে গতকাল সোমবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে দীপংকর তালুকদার পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। সূত্র : জিয়াউর রহমান জুয়েল, রাঙামাটি, খবরের কাগজ ।