

সোমবার ● ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » বাজারফান্ড বিলুপ্ত,সার্কেল চিফকে জেলা পরিষদের সদস্য করতে সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন
বাজারফান্ড বিলুপ্ত,সার্কেল চিফকে জেলা পরিষদের সদস্য করতে সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন
পার্বত্য চট্টগ্রামে কর, মূসক মওকুফ প্রথা রহিত, বাজারফান্ড বিলুপ্ত, ২০২৫ সালের মধ্যে জেলা পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এবং সার্কেল চিফকে সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের সদস্য করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে গত ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্য স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবার প্রকাশ করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ সময় পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে আরও সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন কমিশন।
প্রাথমিক সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদনে সারাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করতে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে সুপারিশ সম্বলিত আলাদা অধ্যায় রয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
৪৬ পৃষ্ঠার প্রাথমিক সুপারিশ প্রতিবেদনটির ১৪ ও ১৫ পৃষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার সম্পর্কে আলাদাভাবে ১৫টি সুপারিশ করেছে কমিশন। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার সম্পর্কে কমিশনের সুপারিশগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি “বিশেষ অঞ্চল” হিসেবে ১৯০০ সনের পর থেকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ভৌগোলিক ভিন্নতা বিশেষতঃ পাহাড়-নদী এবং এখানে বাঙালীসহ মোট ১৩টি ভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর বসবাস। যাদের ভিন্ন ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রথা-রীতি-পদ্ধতি ও সামাজিক আচার-আচরণ রয়েছে।
২. এই অঞ্চলে প্রথাগত হেডম্যান কারবারী সার্কেল প্রধান, বাজার ফান্ড, সংবিধিবদ্ধ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ (বিশেষ আইনে গঠিত) এবং একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য তিন জেলা নিয়ে একটি ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ রয়েছে। এ সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধুমাত্র “বাজার ফান্ড” প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত করে বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠান অক্ষুন্ন রাখা যেতে পারে ।
৩. ‘বাজার ফান্ড’ প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করে বাজার রাজস্ব আহরণের জন্য উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসিল্যান্ড) ও উপজেলা পরিষদ সভাপতির সভাপতিত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে মুক্তভাবে প্রতিযোগিতামূলক নিলামের মাধ্যমে এসব রাজস্ব একটি কেন্দ্রীয় তহবিলে স্থানান্তর করে তা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা সার্কেল-চিফ ও জাতীয় সরকার এর মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী ‘আনুপাতিক হারে’ বণ্টন করা যেতে পারে।
৪. পার্বত্য অঞ্চলের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং-পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তরিত হতে পারে। ‘স্থানীয় সরকার বিভাগ’ প্রতিবছর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জাতীয় বাজেটের পার্বত্য অংশ ঐ মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করে দিতে পারে।
৫. ইউনিয়ন পরিষদসমূহের সাথে হেডম্যান করবারীদের একটি প্রশাসনিক সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে।
৬. ইউনিয়ন পরিষদের বার্ষিক পরিকল্পনা ও বাজেট অধিবেশনে হেডম্যানদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
৭. ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি স্থায়ী কমিটিতে একজন করে হেডম্যানকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
৮. উপজেলা পরিষদে ও পৌরসভায় হেডম্যান-কারবারীদের নিজ নিজ পরিষদ অধিভুক্ত এলাকা থেকে একজন নারী ও একজন পুরুষকে সহযোগী সদস্য হিসাবে যুক্ত হতে পারে।
৯. জেলা পরিষদে স্ব-স্ব জেলার সার্কেল চিফগণ নিয়মিত সদস্য হিসাবে গণ্য হবেন।
১০. জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ২০২৫ এর মধ্যে পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করা যেতে পারে। এ আইনের সংশোধনী পৃথকভাবে সংযুক্ত করা হলো। কারণ ১৯৮৯ এর পর পার্বত্য জেলা পরিষদে কোনো নির্বাচন হয়নি। ফলে এ পরিষদটি রাজনৈতিক বৈধতা হারাতে বসেছে।
১১. আঞ্চলিক পরিষদ আইনের সংশোধন এবং নির্বাচন বিষয়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আপতত যেভাবে আছে তা চলতে পারে।
১২. পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০২৬ সালের মধ্যে পৃথক জনবল, তিন স্তরে ভুমি জরীপ, ইউনিয়ন ও পৌরসভা ভিত্তিক নাগরিক তথ্য-ভান্ডার তৈরি করা প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে।
১৩. যেসকল ক্ষেত্রে পাহড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতীসত্বার অধিবাসীগণের জন্য ব্যবসা, নির্মাণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের উপর কর-মূসক মওকুফ করা আছে, তা প্রত্যাহার করে সমতলের মত কর-মূসক আরোপ করলে সুফল পাওয়া যাবে। এই মওকুফের কারণে দরিদ্র পাহাড়ী-বাঙালী কারও কোনো উপকার হচ্ছে না। একটি মধ্যস্বত্বভোগীর আত্মসাত প্রক্রিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে।
১৪. কর, মূসক মওকুফ হলেও বে-আইনি চাঁদাবাজী পার্বত্য ট্টগ্রামের একটি নির্মম বাস্তবতা। এ চাঁদাবাজির সাথে প্রশাসন, রাজনৈতিক দলসমূহ ও নানা গোষ্ঠী এক ধরনের বন্দোবস্ত তৈরি করেছে। এ বন্দোবস্ত সাধারণভাবে দৃশ্যমান হলেও এখানে যাদের ব্যবস্থা নেয়ার কথা তারা চোখ বন্ধ করে রাখে। এ দুঃসহ অবস্থা ও ব্যবস্থা অবসানের জন্য ব্যাপক নাগরিক সংলাপ করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। একই সাথে প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রেয়োজন।
১৫. ব্যাপক কর্মসংস্থান, জননিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং সীমান্তের বাইরের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হলে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা টেকসই হবার নয়। তাই ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল জাতি গোষ্ঠির শাসন ও উন্নয়নে অংশীদারীত্ব নিশ্চিত করাই হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল লক্ষ্য ও কাজ।
এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠির বিচার-সালিশসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদনের বিভিন্ন অধ্যায়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সেসব বিষয় সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা যাবে।