মঙ্গলবার ● ২১ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » গাজীপুরে চোখ উপড়ে মাথা থেঁতলে প্রতিবন্ধী শিশুকে হত্যা
গাজীপুরে চোখ উপড়ে মাথা থেঁতলে প্রতিবন্ধী শিশুকে হত্যা
গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি :: (৭ আষাঢ় ১৪২৩ বাংলা : বাংলাদেশ সময় রাত ৯.৫০মিঃ) গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার জাহিদুল ইসলাম সজিব নামের এক মানসিক প্রতিবন্ধী এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে ডাকাত সন্দেহে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে, চোখ উপড়ে ও মাথা থেঁতলে হত্যা করেছে নয়ানগর গ্রামের মানুষ ৷ শুধু তাই নয়, পুলিশ নিহত সজিবকে অজ্ঞাতপরিচয় ডাকাত হিসেবে মামলা নিয়েছে দুটি৷
ঘটনা ১১ জুন রাতের হলেও সমপ্রতি মূল ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে ৷ ঘটনার ব্যাপারে কাপাসিয়া থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তারা নিহতের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি বলে জানিয়েছেন ৷
ঘটনার দুদিন আগে ঘর থেকে পালিয়েছিল সচ্ছল পরিবারের মানসিক প্রতিবন্ধী জাহিদুল ইসলাম সজিব ৷ বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দূরের বারিষাব ইউনিয়নের নয়ানগর গ্রামে সে ঘোরাঘুরি করছিল ৷
১১ জুন রাত প্রায় ৯টার দিকে ওই গ্রামের বাসিন্দা একটি বীমা কোম্পানির কর্মকর্তা মিনহাজ উদ্দিনের বাড়ির উঠানে ঢুকে পড়ে ৷ তাকে দেখে চিত্কার করে ওঠে বাড়ির এক কিশোরী ৷ বাড়ির লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে তাকে দেখে ‘ডাকাত-ডাকাত’ বলে চিত্কার করলে ভয়ে পাশের গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ে সজিব ৷ এরপর বাড়ির প্রধান ফটক তালাবদ্ধ করে ওই গোয়ালঘরের ভেতর তাকে নির্দয়ভাবে পেটায় বাড়ির লোকজন ৷ ডাকাত হানা দিয়েছে ভেবে ততক্ষণে বাড়ির সামনে লাঠিসোটা হাতে জড়ো হয় ১০০ থেকে ১৫০ গ্রামবাসী ৷ পরে হাত-পা বেঁধে তাকে তুলে দেওয়া হয় গ্রামবাসীর হাতে ৷ তারা প্রথমে বেধড়ক পিটুনি দিয়ে দুপায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো করে গাছের সঙ্গে ঝোলায় ৷ গাছে ঝুলিয়ে ‘ডাকাত সহযোগীদের’ পরিচয় জানার নামে নিষ্ঠুরভাবে মারধর করা হয় ৷ জবাবে সজিব দু-তিনবার স্রেফ জবাব দিয়েছিল ‘খিদা লাগছে’ বলে ৷ এতে গ্রামবাসী আরও ক্ষিপ্ত হয় ৷ তারা মাটিতে ফেলে শাবল দিয়ে একটি চোখ উপড়ে উল্লাস করে ৷ তারপর মাথা থেঁতলে দেয় ৷ খবর পেয়ে টহল পুলিশ সেখানে পৌঁছে তাকে উদ্ধার করে কাপাসিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্ষে নিয়ে যায় ৷ সেখানে কর্তব্যরত চিকিত্সকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন ৷
পরিবার সূত্র আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি মুহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিককে জানায়, জাহিদুল ইসলাম সজিব (১৮) কাপাসিয়ার ঘাগটিয়া ইউনিয়নের খিরাটি উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত জাকির হোসেন মুকুলের একমাত্র ছেলে ৷ সে খিরাটি বঙ্গতাজ ডিগ্রি কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ৷ কিন্তু মস্তিষ্কে সমস্যা দেখা দেওয়ায় পরীক্ষায় অংশ নেওয়া হয়নি তার ৷ গত প্রায় আড়াই মাস ধরে সজিবকে বদ্ধপাগল বলেই জানত গ্রামবাসী ৷
এদিকে ঘটনার পরদিন খবর পেয়ে নিহত ওই হতভাগ্য ছেলেটির স্বজনরা থানায় গেলেও মৃতদেহ দেখতে দেয়নি পুলিশ ৷ অজ্ঞাতপরিচয় ডাকাত হিসেবে পুলিশ সজিবের মৃতদেহ গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় ৷ শুধু তাই নয়, গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনাসহ ডাকাতির চেষ্টা করায় সজিবের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলাও নেয় পুলিশ ৷ পরে মর্গ থেকে শনাক্ত করে স্বজনরা মৃতদেহ নিয়ে দাফন করেন ৷
স্বজনদের অভিযোগ, ঘটনার রাতেই নিষ্পাপ একজন মানসিক প্রতিবন্ধীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জেনে যায় পুলিশ ৷ তারপরও তাকে অজ্ঞাতপরিচয় ডাকাত বলেই মামলা নেয় ৷ শুধু তাই নয়, হত্যাকান্ডে ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ তাড়িয়ে দেয় স্বজনদের ৷
খিরাটি বঙ্গতাজ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আওলাদ হোসেন আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধিকে জানান, সজিব ছিল খুবই মেধাবী ছাত্র ৷ কিন্তু নির্বাচনী পরীক্ষার পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় ফরম পূরণ করা হয়নি তার ৷
সজিবের চাচা দুবাই প্রবাসী আনোয়ার হোসেন আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধিকে জানান, একমাত্র ভাতিজার এমন অবস্থা দেখে তিনি আর বিদেশে যাননি ৷ অনেক চেষ্টা করেও তারা সজিবকে চিকিত্সকের কাছে নিতে পারেননি ৷ ব্যর্থ হয়ে অনেক কবিরাজ ডেকে এনে বাড়িতে রেখেই সজিবের চিকিত্সা করিয়েছেন ৷ কিন্তু সুফল না পাওয়ায় তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সজিবকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করার ৷
সজিবের মা রেবেকা সুলতানা রেবা আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধিকে জানান, প্রায় দুমাস আগে ওই ঘর থেকে সজিব একবার বেরিয়ে গিয়েছিল ৷ পরে ব্যাপক খোঁজাখুঁজির পর পাশের আড়ালবাজার থেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয় ৷ এরপর থেকে সজিব নিজেই ঘরের ভেতর থেকে তালাবদ্ধ করে থাকত ৷ খাবার সময় হলেই সে নিজেই খুলে দিত তালা ৷ সজিব কারও সঙ্গে কথাও বলত না ৷ তার থাকার ঘরে কেউ যেতে চাইলে ক্ষেপে যেত সে ৷
সজিবের দাদি শুক্কুরি বেগম আরও আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধিকে জানান, গত ৯ জুন রাতে বারান্দার গ্রিল ভেঙে বেরিয়ে যায় সজিব ৷ এরপর থেকে তার খোঁজ পাননি তারা ৷
এদিকে সজিব হত্যার ঘটনায় এসআই সেন্টু চন্দ্র সিংহ অজ্ঞাতপরিচয় ১০০ থেকে ১৫০ জন গ্রামবাসীকে আসামি করে মামলা করেন ৷ এ মামলা তদন্ত করছেন এসআই শাহজাহান মিয়া ৷
এসআই সেন্টু চন্দ্র সিংহ আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধিকে জানান, গণপিটুনিতে নিহত ওই ডাকাত ছাড়া অন্য কোনো ডাকাতকে কেউ দেখেনি ৷ নিহতের সঙ্গে আরও কেউ ছিল কি না তারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না ৷ এসআই শাহজাহান মিয়া জানান, গণপিটুনিতে নিহত ডাকাতের পরিচয় এখনো নিশ্চিত করতে পারেননি ৷ তবে লোকমুখে শুনছি, ছেলেটি নাকি পাগল ছিল ৷ বিষয়টি বুঝতে পারছি না ৷
কাপাসিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু বক্কর সিদ্দিক আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি মুহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিককে বলেন, নিহত ডাকাতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে ৷ গাজীপুরের অতিরিক্তি পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন জানান, বিষয়টি তার জানা নেই ৷ তবে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব ৷