শুক্রবার ● ১৯ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » ঝিনাইদহে ধেয়ে আসছে মাদকের বিষাক্ত ছোবল
ঝিনাইদহে ধেয়ে আসছে মাদকের বিষাক্ত ছোবল
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :: (৪ ভাদ্র ১৪২৩ বাংলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৮.১৫মিঃ) মাদক উপত্যাকায় পরিণত হয়েছে ঝিনাইদহ৷ জেলার ৬ উপজেলায় এখন মাদক বিক্রি হচ্ছে অবাধে৷ মাদকের অন্যতম গেটওয়ে হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ঝিনাইদহ৷ এর অন্যতম কারণ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নির্বিঘ্নে পাচারের নিরাপদ রুট৷
সীমান্তে বিজিবি আর থানায় থানায় পুলিশ ও র্যাব মাদকের এই ভয়াবহতা থামাতে পারছে না৷ বিশেষ করে সীমান্ত রুটে ব্যাপক ভাবে মাদক প্রবেশ করায় র্যাব পুলিশের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে৷ নিয়মিত সন্ত্রাস ও জঙ্গী বিরোধী অভিযান চালানোর পাশাপাশি মাদকের শ্রোত ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃংখলা বাহিনী৷
অন্যদিকে ঠুটো জগন্নাথে পরিণত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর৷ লোকবলের দোয়ায় দিয়ে তারা হাত পা গুটিয়ে বসে আছে৷ ব্যাবসায়ীদের লেজ না পেলেও তারা মাঝে মধ্যে সেবনকারীদের আটকিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে সক্ষক হচ্ছে৷
বিজিবির ৬ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের দেওয়া তথ্যমতে গত দেড় বছরে ৫ কোটিরও বেশি টাকার মদক উদ্ধার করেছে তারা৷ গত ২১ জানুয়ারী এ সব মাদক চুয়াডাঙ্গায় ধ্বংস করা হয়৷ ঝিনাইদহের খালিশপুর ৫৮ বিজিবি গঠনের পর থেকে সীমান্ত থেকে অর্ধ কোটি টাকার মাদক উদ্ধারের তথ্য রয়েছে৷
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিনাইদহ র্যাব ও পুলিশ আমদানীর তুলনায় খুব কম পরিমান মাদক উদ্ধার করতে পারছে৷ অভিযোগ আছে, সখ্যতা থাকায় মাদক সম্রাটরা থেকে যাচ্ছে অধরা৷ চুনোপুটি মার্কা ব্যবসায়ীরা পুলিশের জালে বন্দি হলেও এ ব্যবসার আড়ালে থাকা গডফাদাররা গ্রেফতার হয় না৷ সরকারের বিশেষ একটি সংস্থার রিপোর্ট মোতাবেক ঝিনাইদহ জেলায় কোন না কোন ভাবে জড়িত ৭০০ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে৷
এসব মাদক ব্যবসায়ীরা প্রায়ই পুলিশ, বিজিবি বা র্যাবের হাতে গ্রেফতার হলেও বেশিদিন জেলে আটকে থাকে না৷ দুর্বল ধারা ও সাক্ষি প্রমানের অভাবে তারা বের হয়ে আসে এবং পুরোদমে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে৷
ঝিনাইদহের রবি নামে এক মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতারের পর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, এই নিয়ে সে ৪ বার গ্রেফতার হলো৷ কিন্তু প্রতিবারই জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবারো জড়িয়ে পড়ে মাদক ব্যবসার সাথে৷ বৈডাঙ্গার গাজা সম্রাট শহিদুল প্রায় গ্রেফতার হয়৷ কিন্তুু জেলের ভাত তার বেশি দিন খেতে হয় না৷
সর্বশেষ তিনি র্যাবের হাতে বিপুল পরিমান গাঁজাসহ আটক হন৷ এদিকে সহজলভ্য হওয়ায় এখন ফেনসিডিল ছেড়ে ইয়াবায় ঝুকছে ব্যবসায়ীরা৷ ফলে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের বিশাক্ত নীল ছোবল৷ পানের দোকানেও এখন ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে৷
ফলে উঠতি বয়সের যুবকরা আক্রান্ত হচ্ছে মাদক জ্বরে৷ সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে ঝিনাইদহ অঞ্চলে এখন প্রভাবশালীরা মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে৷ এই তালিকায় অবাক করার মতো তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি৷
তাদের কাছে তথ্য আছে নামধারী জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মাদকের বড় বড় চালান পাচার হচ্ছে৷ কতিপয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও চেয়ারম্যানরাও জড়িয়ে পড়েছে এই ব্যবসায়৷ অন্যদিকে পুলিশের কতিপয় সদস্যও মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়েছে৷
গত ২৮ জুলাই চাকলাপাড়ার লুত্ফর রহমানের ছেলে মাদক সম্রাট রবি গ্রেফতার হওয়ার পর কয়েকজন গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যের নাম ফাঁস করে মিডিয়ার কাছে৷ তাদেরকে তড়িঘড়ি করে অন্য জেলায় বদলী করা হয়েছে৷ গত ১০ আগষ্ট আরাপপুরে মাদক নিয়ে গোলাগুলি হয়ে একজন গুরুতর আহত হন৷
এ নিয়ে প্রশাসনের কোন উচ্চবাচ্য নেই, নেই অগ্রগতি৷ গত ২৭ জুলাই রাতে সাদা পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোক ঝিনাইদহ সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের ছমির উদ্দীনের ছেলে মাদক ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম ও কোলা গ্রামের মৃত সৈয়দ মালিথার ছেলে রেজাউলকে ইয়াবাসহ আটক করে৷ কিন্তুু তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়নি৷ পুলিশ তাদের আটকের কথাও স্বীকার করেনি৷
এলাকায় ফিরে শহিদুল ও রেজা তাদের আটকের কথা জানিয়ে বলেছে টাকা দিয়ে তারা ছাড়া পেয়েছে৷ ১৬ আগষ্ট ঝিনাইদহ শহরের পার্কপাড়া থেকে এক প্রকৌশলীর ছেলে ফেনসিডিলসহ ধরা পরে৷ মোটা অংকের টাকা লেনদেনে মুক্তি পান তিনি৷ এ ভাবে সাদা পোশাকে মাদক ও মাদকদ্রব্য আটক হলেও থানা পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না৷ রাস্তার মধ্যে দরদাম হাঁকিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অনেক নজীর রয়েছে৷
ঝিনাইদহের পশ্চিমের এক পুলিশ ফাড়ির এএসআই মাদক ব্যবসা করে অল্প দিনে গ্রামে আলিশান বাড়ি ও মাঠে জমি কিনে তাক লাগিয়ে দিয়েছে৷ তিনি বদলী হয়েছেন সাতক্ষিরা জেলায়৷ রাতে একটি সাদা প্রাইভেট কার নিয়ে তিনি মাদক ব্যবসা করতেন বলে এলাকায় কথিত আছে৷ হরিণাকুন্ডুর রিশখালী এলাকার এক গাজা ব্যবসায়ী ৩ কেজি গাজাসহ গ্রেফতার করে৷ কিন্তু টাকা নিয়ে ওই এএসআই তাকে ছেড়ে দেয়৷
কোটচাঁদপুরের মাদক ও চোরাচালান সিন্ডিকেটের গডফাদার রেজাউল পাঠান র্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর কতিপয় নামধারী সাংবাদিকের নাম প্রকাশ করেছে৷ এরা মাদক সেবন ও ব্যবসার সাথে জড়িত৷ সাংবাদিক সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অনেকেই এখন ঝুকছে মাদক ব্যবসার সাথে৷
ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর, কালীগঞ্জের বারোবাজার, কোটচাঁদপুর, শৈলকুপার শেখপাড়া, ভাটই, গাড়াগঞ্জ ও মহেশপুরের সীমানত্ম এলাকা মাদকের রমরমা হাটে পরিণত হয়েছে৷ চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, খাড়াগোদা ও শরত্গঞ্জ হয়ে প্রতি রাতেই মাদকের বড় বড় চালান ঝিনাইদহে ঢুকছে৷
এই এলাকার গডফাদাররা এ সব ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করছে৷ এ বিষয়ে খালিশপুর ৫৮ বিজিবির পরিচালক লেঃ কর্ণেল তাজুল ইসলাম তাজ জানান, সীমানত্ম থেকে পাঁচ মাইলের মধ্যে আমাদের এরিয়া৷ এর বাইরে কোন কিছু হলে আমাদের আইনগত কিছু করার নেই৷
তিনি বলেন প্রতিনিয়িত আমরা সীমান্তে মাদক বিরোধী অভিযান চালাচ্ছি৷ আজ ১৯ আগষ্ট শুক্রবারও আমরা মদ ও ৭২ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছি৷ তিনি বলেন, মাদকের শ্রোত ঠেকাতে আমরা সীমান্তে অভিযানের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি৷
ইমামদের মাধ্যমে মসজিদে মসজিদে মাদক নিয়ে ইসলামের দৃষ্টি ভঙ্গি তুলে ধরছি৷ সীমান্তে মেম্বর ও চেয়ারম্যানদের নিয়ে কাজ করছি৷ তারপরও মাদকের ভয়াবহতা ঠেকানো যাচ্ছে না৷ তিনি বলেন, আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের আটক করে মামলা দিই৷ এরপর আমাদের আর কোন কাজ নেই৷
বিজিবির আরেকটি সুত্র জানায়, মাদক ব্যবসায়ীরা সব সময় সরকারী দলের ছত্রছায়ায় ব্যবসা করে৷ এ জন্য তাদের গ্রেফতার করলেও বেশিদিন আটকানো যায় না৷ এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, মাদকের সাথে সমাজের অনেকই জড়িত৷ তারপরও পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে৷
অভিভাবকরা সচেতন না হলে পুলিশের একার পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয়৷ তিনি জানান, আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের ধরছি, কিন্তুু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বেরিয়ে আবার পুরানো পেশায় ফিরে আসছে৷